মৃত্যু দুয়ারে ছিল সেদিনও

১৯৮৬ সাল, মাদ্রাজ টেস্ট। আড়াই বছর আগে অভিষিক্ত এক তরুণ এবার আবারো ফিরেছেন ক্রিকেটে। আর কি রাজসিক সে ফেরা, প্রত্যাবর্তনটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য যা যা দরকার তার সবটাই করলেন তিনি।

৫০৩ মিনিট, ৩৩০ বল, ২ ছক্কা ২৭ চারে ২১০ রান – ইনিংসটা আজো ভারতের মাটিতে কোনো অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসে। তবে, সেই পরিশ্রমী ইনিংসকে ব্যাখ্যা করার সাধ্য পরিসংখ্যানের কই!

৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল, আর ৮০ শতাংশ আর্দ্রতা মিলে মাদ্রাজের চীপক স্টেডিয়াম ছিল স্রেফ একটা জ্বলন্ত চুলা। সেই প্রখর উত্তাপে পানি শূণ্যতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন, বমিও হয়। আউট আউট হওয়ার পরপরই তাই সেই ক্রিকেটারকে হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন দেয়া হয়।

সেই দফায় ওজন কমেছিল পাক্কা আট কেজি।

সেই ঘটনার পর কেটে গেছে অনেকদিন। সেদিনের তরুণ ততদিনে ক্রিকেটের কিংবদন্তি হিসেবে বাইশ গজ ছেড়ে কখনো কোচিং করিয়েছেন, মন দিয়েছেন ধারাভাষ্যকক্ষে প্রায় ৩৪ বছর পর আবারো তিনি ভারতেরই এক হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এবার মুম্বাই। তবে, এবার আর ফেরা হল না।

মাদ্রাজের সেই বিরুদ্ধ পরিবেশে যার কিছুই হয়নি, সেই ডিন জোন্সকে হার মানালে হার্ট অ্যাটাক। তাই, ৫৯ বছর বয়সেই ইতি ঘটলো জীবনের ইনিংসের। অথচ, এর আগেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) প্রিভিউ অনুষ্ঠানে দিব্যি কথা বলেছেন। ওই যে বলে না, ‘দম ফুরাইলে ঠুস!’

১৯৮৩-৮৪ গ্রীষ্মের শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়া দলে একটা হাহাকার চলছিল। গ্রেগ চ্যাপেল চলে গেছেন। ক্রকেট অস্ট্রেলিয়া হন্যে হয়ে একজন বদলি খুঁজছিল। অবসরে যাওয়া এই কিংবদন্তির ফাঁকা চেয়ারে বসার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল ভিক্টোরিয়ার তরুণ প্রতিভা জোন্সকে। এই বিশ্বাসের দারুণ প্রতিদান দিয়েছেন তিনি।

চেন্নাইয়ে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বিখ্যাত সেই টাই টেস্টটার জন্য আজীবন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে জোন্সের নাম। ৫২ টি টেস্ট এবং ১৪৮ টি ওয়ানডে খেলেছিলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ১৯৮৭ বিশ্বকাপজয়ী দলেরও ছিলেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় ১০ হাজার রান করা ডিন মার্ভিন জোন্সকে আশির দশকের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান বলা যায় না। কারণ তিনি ছিলেন স্বয়ং ভিভ রিচার্ডসনের সমসাময়িক ক্রিকেটার।

১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। অবসরের পর বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন, কোচিং করিয়েছেন, বিশ্লেষক হিসেবেও কাজ করেছেন। আগামী বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ডিন জোন্সকে দলের স্টাফ প্যানেলে নেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন অজি ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার। এ নিয়ে জোন্সের সাথে কথাও হয়েছিল তাঁর। কিন্তু, সেই পরিকল্পনাও ভেস্তে গেল।

দারুণ ফিল্ডার ছিলেন জোন্স। দেশের প্রতি ছিল অগাধ ভালবাসা। মাদ্রাজের সেই টেস্টের আগেই ১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সফরে যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। সেটা ছিল ট্যাক্সহীন দুই লাখ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের বিরাট একটা প্রস্তাব। সেই অর্থ দিয়ে দিব্যি তিনটা বাড়ি কিনে ফেলতে পারতেন। কিন্তু, সেই হাতছানিতে এগোননি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) তিন হাজার ডলার পারিশ্রমিক পাওয়া ক্রিকেটারটি।

কারণ, বাবা বলেছিলেন, ‘ভারতের বিপক্ষে এমন লড়াই করো যাতে দুনিয়া মনে রাখে।’

সেই মনে রাখার কাজটি করতে পেরেছিলেন জোন্স। সেই ইনিংস খেলতে আক্ষরিক অর্থেই জীবন বাজি রেখেছিলেন। হয়তো মারাও যেতে পারতেন। একবার বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটকে ভালবাসতে গিয়েই যদি আমার জীবন দিতে হয়, আর তখন যদি ব্যাগি গ্রিন মাথায় ক্রিকেট মাঠেই থাকি – তাহলে এর চেয়ে ভাল ব্যাপার আর কি বা হতে পারে!’

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link