এক দশক পর হিসাবের খাতা নিয়ে সকলেই বসছেন। আমরাও বসি। তবে দশক সেরা দল অনেকেই বানাচ্ছেন, তাই সেই পথ দিয়ে হাঁটছি না। টেস্ট ও ওয়ানডের নিরিখে, দশকের সেরা পাঁচ ম্যাচ, সেরা পাঁচ ইনিংস, সেরা পাঁচ স্পেল ইত্যাদি বেছে নেবো।
এবার ওয়ানডে ক্রিকেটে গত দশকের সেরা পাঁচ স্পেল নিয়ে বলবো। আগেই বলে রাখছি, উইকেটের বিচারে আমি সেরা স্পেল বিচার করিনি। তার প্রভাব, পরিস্থিতি, প্রতিপক্ষ ইত্যাদিকে আমি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছি এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে।
তাহলে আর দেরি না করে শুরু করা যাক।
- মিশেল স্টার্ক: ৯ ওভারে ২৮ রানে ৬ উইকেট
প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, অকল্যান্ড, ২০১৫ বিশ্বকাপ
মিশেল স্টার্ক ওয়ানডে খেলেন কম। কিন্তু যখন খেলেন, বিপক্ষকে চোখে তারা দেখানোর ক্ষমতা রাখেন। এই ম্যাচেও ঠিক তাই করেছিলেন স্টার্ক। ম্যাকালাম ও উইলিয়ামসন ছাড়া সব ব্যাটসম্যানকেই কাঁদিয়ে ছেড়েছিলেন স্টার্ক সেই ম্যাচে। ১৫১ রান নিয়ে স্টার্কের ওই অসামান্য লড়াই আজও চোখে লেগে আছে। নেহাৎ তখন অনভিজ্ঞ কামিন্স উইলিয়ামসনের কাছে ছয় খেয়ে গেলেন, নাহলে স্টার্কের শেষ ওভারে ম্যাচের ফলাফল কি হতো জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।
- রুবেল হোসেন: ১০ ওভারে ৫৩ রানে ৪ উইকেট
প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, অ্যাডিলেড, ২০১৫ বিশ্বকাপ
সেই বিশকাপে ব্যাটিং সহায়ক নিয়মের ফাঁসে যেভাবে রান হচ্ছিলো, প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশের ২৭৫ সেরকম পাতে দেয়ার মতো রান ছিলো না। মোটামুটি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, বেল-হেলস এবং বেল -রুট জুটি যেভাবে ক্রিজে জমে গেছিলো, তাতে প্রথম বার বিশ্বকাপের নক-আউট পর্বে যাওয়ার আশা বাংলাদেশ সমর্থকরা এক প্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন।
এই সময় এক ওভারে বেল এবং অধিনায়ক মরগ্যানকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান ব্যক্তিজীবনে চিরবিতর্কিত রুবেল। এরপর যখন দু’ওভারে ১৫ রান বাকি, সেই সময় ব্রড ও অ্যান্ডারসনকে ফিরিয়ে বিশ্বকাপ নক আউটের গর্বের মিনারে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন রুবেল। ভারতীয় সমর্থকদের কাছে যেমন ধোনির ছক্কা এবং মহিন্দর অমরনাথের শেষ উইকেট অমর চিত্রকথা সম নস্টালজিক এবং অবিস্মরণীয় দৃশ্যপট, বাংলাদেশ সমর্থকদের কাছেও রুবেলের ওই ইয়র্কার সেরকম দৃশ্যপটের সৃষ্টি করেছে।
- ওয়াহাব রিয়াজ: ৯ ওভারে ৫৪ রানে ২ উইকেট
প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, অ্যাডিলেড, ২০১৫ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল
উইকেট দিয়ে এই স্পেলের বিচার করবেন না পাঠক। পূর্বেকার পরিস্থিতি একটু বলে দি। পাকিস্তানের ‘বিশ্বস্ত’ ব্যাটিং লাইনআপ পাটা পিচে টেনেটুনে করেছে ২১৩।রিয়াজ বল করতে এসে দেখছেন অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে ৮ ওভারে ৪৫। ক্রিজে ধ্বংসাত্মক ডেভিড ওয়ার্নার। রিয়াজ বোধহয় অধিনায়ক মিসবাহকে বলেই দিয়েছিলেন, যা হয় হবে, আমাকে একটা শর্টলেগ দাও।
আমি যত জোরে পারি বল করবো। ওয়ার্নারকে ফেরালেন জলদি। কিন্তু যে কারণে এই স্পেল স্মরণীয়, সেই রিয়াজ-ওয়াটসন ডুয়েল এরপর শুরু হয়। উপমহাদেশীয় দল অস্ট্রেলিয়া গেলে, তাদের ব্যাটসম্যানরাই আগুনে শর্ট-পিচ বোলিংয়ের বিরুদ্ধে সিঁটিয়ে থাকেন। কিন্তু পাশার দান সেদিন উল্টে দেন ওয়াহাব রিয়াজ।
শেন ওয়াটসনের মতো ব্যাটসম্যান যে কঠিন শর্টপিচ বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এতটা সিঁটিয়ে থাকতে পারেন, রিয়াজের এই স্পেল না থাকলে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব জানতোই না। রিয়াজ হয়তো সেদিন পাকিস্তানকে জিতিয়ে ফিরতেও পারতেন, এবং তাহলে তালিকার এতো নিচের দিকে থাকতো না এই স্পেল। কিন্তু পাকিস্তানকে ডোবানোর জন্যে তাদের ‘বিশ্বস্ত’ ফিল্ডিং তো আছেই। কিন্তু এতো কিছু সত্ত্বেও, ওয়ানডে ক্রিকেটে রিয়াজের সেই স্পেল আজও মনে দাগ কাটে।
- টিম সাউদি, ৯ ওভারে ৩৩ রানে ৭ উইকেট
প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ওয়েলিংটন, ২০১৫ বিশ্বকাপ
শুধু উইকেট সংখ্যার দিক দিয়ে নয়। এই স্পেলের গুরুত্ব বা গভীরতা অনেক সুদূরপ্রসারী। সেই বিশ্বকাপে এই ম্যাচের আগে অব্দি ক্রিকেট দর্শক মনে মনে সমঝোতা করে নিয়েছে, এই বিশ্বকাপে বোলারদের কাড়িকুড়ি দেখার বিশেষ সুযোগ হবে না।
তার চেয়ে বরং ব্যাটিংয়ের ফুলঝুরি তে মনোনিবেশ করে বিশ্বকাপ উপভোগ করা যাক। কিন্তু টিম সাউদি প্রথমবার সেই বিশ্বকাপে বোলারদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সৌজন্যে এই স্পেল। শুধু জায়গায় বলটা রেখে গেলে এবং হালকা সুইং করলে, মহাপরাক্রমী গদাধারী ব্যাটসম্যানদেরও যে অনেক সময় হাওয়া টাইট হয়ে যায়, সেটা সেদিন বেশ ভালোভাবেই বোঝা গেছিলো।
- ওয়াহাব রিয়াজ, ১০ ওভারে ৪৭ রানে ৫ উইকেট
প্রতিপক্ষ ভারত, মোহালি, ২০১১ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
তিনি এক প্রহেলিকা। ঠিক যেন হ্যালির ধূমকেতু। তবে ৭৬ বছর অন্তর নয়। ২০১৫ সালের সেই বিদ্ধংসী স্পেলের ঠিক চার বছর আগে, এই ওয়াহাব রিয়াজের ক্রিকেট আকাশে আগমন হয়। মঞ্চটা কল্পনা করুন। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল বনাম ভারত। পরিস্থিতিটা কল্পনা করুন। শোয়েব আখতারের বিতর্কিত জুতোয় পা গলানো। প্রতিপক্ষ টা কল্পনা করুন। শেবাগ, শচীন, ধোনি, যুবরাজ, গম্ভীর, কোহলি। কিন্তু তাঁরা নন। মোহালির সেই বিকেলে, ম্যাচের মুজরিম ছিলেন ওয়াহাব রিয়াজ।
বিধ্বংসী সেহওয়াগকে আউট করা দিয়ে শুরু। অল্প পুরোনো বলে, অসামান্য রিভার্স সুইংয়ে কোহলি, যুবরাজ ও ধোনিকে আউট দিয়ে শেষ। ভারতীয় ব্যাটিংয়ের বুক থেকে পেট এক হাতেই শেষ করেন রিয়াজ। সুন্দর ব্যাটিং উইকেটে ভারতকে মাত্র ২৬০ রানে আটকে রাখেন। কিন্তু ওই! পাকিস্তানের ‘বিশ্বস্ত’ ব্যাটিং ও ফিল্ডিং লাইন-আপ আবারো রিয়াজের অসামান্য স্পেলের মর্যাদা রাখতে ব্যর্থ হন।