তাঁর জীবনটাই যেন আস্ত রূপকথা। দ্বিতীয় বিভাগের ক্রিকেট খেলতে হয়েছে বড় একটা সময়। ক্যারিয়ার বাঁচাতে দেশ বদলেছেন, তবু ক্রিকেট ছাড়তে পারেননি। পড়ন্ত বেলায় ক্রিকেট ঈশ্বর যেন সব দেনা তাই সুদে-আসলে মিটিয়ে দিচ্ছেন। তিনি ডেভন কনওয়ে, লর্ডস ছাপিয়ে যিনি রানের সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছেন সুদূর ভারত মূলুকে।
বাবা ছিলেন ফুটবল কোচ, শৈশবটা তাই কেটেছে গোলাকার চর্ম গোলকের সাথেই। কিন্তু কৈশোরে পা রাখতেই ছোটবেলার প্রেমটা বদলে গেল, মজলেন ক্রিকেটের প্রেমে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়াটা বোধহয় ক্রিকেটবিশ্বের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটা। মাঠের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি যে মিশে থাকে সাদা-কালোর লড়াইটাও।
ভাগ্যটা বদলায়নি কনওয়ের বেলাতেও। বয়সভিত্তিক দলের সতীর্থ কুইন্টন ডি কক, টেম্বা বাভুমারা যখন ছোটদের বিশ্বকাপ খেলে জাতীয় দলে সুযোগের অপেক্ষার প্রহর গুণছেন, কনওয়ে তখন প্রাদেশিক দলেই নিয়মিত নন। দ্বিতীয় বিভাগের ম্যাচে রানের পর রান করে গেলেও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি।
মাঝে কিছু ম্যাচে অবশ্য লায়ন্স তাঁকে বাজিয়ে দেখার সুযোগ নিয়েছিল। কিন্তু কনওয়ে সেই সুযোগটা নিতে পারেননি। অবশ্য নিয়মিত তাঁর উপর ভরসাও করেনি দলটি, কেবলমাত্র কারো ইনজুরি হলেই দলে ডাক পড়তো তাঁর। ফলে ছয় বছর পেরিয়েও প্রথম শ্রেণির গড়টা ত্রিশের কাছাকাছি যায়নি, পায়ের নিচের মাটিটাও তাই যথেষ্ট নড়বড়ে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই বোধকরি মানুষের সেরাটা বেরিয়ে আসে, কনওয়েও তাঁর ব্যতিক্রম নন। ক্রিকেট ছাড়া কনওয়ে জীবনটা কল্পনাও করতে পারেন না, সে কারণেই কিনা ভাবলেন বিকল্প পথ। স্ত্রীকে সাথে নিয়ে উড়াল দিলেন নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্য, পেছনে ফেলে গেলেন শৈশবের অজস্র স্মৃতি।
ওয়েলিংটনে আসার পর থেকেই যেন ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে কনওয়ের। ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে ওয়েলিংটন দলে সুযোগ পেতে সময় লাগলো না। ট্ম ব্ল্যান্ডেলের জাতীয় দলে ডাক পাবার সুবাদে তিন ম্যাচ তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চাইলো ওয়েলিংটন ম্যানেজমেন্ট। এবারে আর সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না, দুই ম্যাচেই ফিফটি হাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিলেন নিজের সামর্থ্য।
এরপরের গল্পটা কেবলই এগিয়ে যাবার। নিউজিল্যান্ডের সবগুলো ঘরোয়া টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান করে গেলেন প্রতিনিয়ত, কিউই ক্রিকেট বোর্ডও তাই তোড়জোড় শুরু করলো তাঁকে জাতীয় দলে খেলানোর। ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে টেস্ট অভিষেকও রাঙিয়ে তুললেন অনবদ্য এক ডাবল সেঞ্চুরি করে। স্টুয়ার্ড ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসন কিংবা মার্ক উডদের সেদিন বড্ড অসহায় লাগছিলো কনওয়ের সামনে। কে জানে রান আউট না হলে হয়তো সেদিন অভিষেকে ত্রিপল সেঞ্চুরির রেকর্ডে কাইল মায়ার্সের সাথে তাঁর নামটাও থাকতো!
লাল বলের ক্রিকেটে যেমন শান্ত ধীরস্থির, টি টোয়েন্টিতে তেমনই বিধ্বংসী কনওয়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯৯ রানের এক মারকুটে ইনিংসের পর রবিচন্দ্রন অশ্বিন টুইট করেছিলেন, ‘কনওয়ে ইনিংসটা খেলতে বোধহয় চারদিন দেরি করে ফেললেন!’ উল্লেখ্য যে চারদিন আগের আইপিএল নিলামে এই কিউই তারকাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো দলই।
তবে ভুলটা শোধরে নিতে মোটেই দেরি করেনি মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংস। পরের নিলামে প্রথম সুযোগেই তাঁরা দলে ভেড়ায় কনওয়েকে। কিন্তু দারুণভাবেই না আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন এই কিউই তারকা, ভারতীয় তরুণ রুতুরাজ গায়কোয়াড়কে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ভরসাযোগ্য এক উদ্বোধনী জুটি।
প্রথম মৌসুমে মাত্র পাঁচ ম্যাচে সুযোগ পেয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। দ্বিতীয় মৌসুমে যেন নিজেকে ছাপিয়ে যাবার মিশনে নেমেছেন, এখনো পর্যন্ত সাত ম্যাচে প্রায় দেড়শো ছুঁইছুঁই স্ট্রাইকরেটে করেছেন ২৫২ রান। ব্যাঙ্গালুরুতে হাসারাঙ্গা-পারনেলদের বিপক্ষে রুতুরাজ শুরুতে ফিরলেও একপ্রান্ত আগলে রেখেছেন কনওয়ে। রানের চাকা কমতে দেননি একবারো, সমান ছয়টি করে চার এবং ছক্কায় ব্যক্তিগত ৮৩ এবং দলীয় ১৭০ রানে যখন ফিরছেন ততক্ষণে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেছে চেন্নাই।
জোহানেসবার্গ, ওয়েলিংটন, হ্যাগলি ওভাল কিংবা লর্ডস পেরিয়ে ভারত মূলুকের চেন্নাস্বামী কিংবা ব্যাঙ্গালুরু, কনওয়েরা যেন জীবনের জয়গান গেয়ে বেড়ান সবখানেই।