‘মাঠে তাঁর উপস্থিতি মানে প্রতি পজিশনে দুইজন করে খেলোয়াড় থাকা।
উক্তিটি রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি কোচ মিগুয়েল মুনেজের। আর কথাটা বলা হয়েছে আরেক কিংবদন্তি ফুটবলারের উদ্দেশ্যে। যিনি নিজের সময়ে রিয়াল মাদ্রিদের কাণ্ডারি ছিলেন, তার নেতৃত্বেই ইউরোপের অন্যতম সেরা ক্লাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে স্প্যানিশ ক্লাবটি। তিনি রিয়াল মাদ্রিদের অগ্রযাত্রার অগ্রণী পথ প্রদর্শক – আলফ্রেডো ডি স্টেফানো।
মাঠে ডি স্টেফানো নামতেন স্ট্রাইকার হিসেবে। কিন্তু খেলতেন কোন ভুমিকায় সেটি জিজ্ঞেস না করে বরং কোথায় খেলতে না সেটা জিজ্ঞেস করাই বোধহয় ভাল। স্টেফানো প্রায় সব সেন্ট্রাল পজিশনেই খেলতেন; সেন্টার ফরোয়ার্ড, সেকেন্ড স্ট্রাইকার কিংবা নাম্বার টেন তো বটেই সেন্ট্রাল হিসেবও দেখা যেত তাকে। অবাক হওয়ার কারন নেই, কেননা স্টেফানো-কে কখনো আবার সেন্টারব্যাকের দায়িত্ব সামলাতেও দেখা গিয়েছে।
এটা জানার পরে আপনি কি ভার্সেটাইল প্লেয়ারের কথা ভাবছেন? না এমনটা ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ ডি স্টেফানো যে একেক ম্যাচে একেক পজিশনে খেলতেন বিষয়টি এমন নয়। বরং একই ম্যাচে একাধিক ভুমিকায় দলকে সেবা দিতেন এই কিংবদন্তি ফুটবলার।
ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ফুটবলার স্যার ববি চার্লটন ডি স্টেফানোকে খেলতে দেখার পর বলেছিলেন, ‘কে এই লোক? উপর থেকে নেমে গোলকিপারের কাছ থেকে বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সাথে আবার ডিফেন্ডারদের নির্দেশনা দিচ্ছে। একটা প্লেয়ার এত কমপ্লিট কিভাবে হয়, মাঠের সবখানে দেখা যাচ্ছে তাকে! মাঠের যেখানে গিয়ে দাঁড়ায় বল মনে হয় ঠিক ওখানে চলে আসে জাদু জানে নাকি সে?’
হ্যাঁ, জাদুই জানে বোধহয়, সেই জাদুর বলেই নিজের পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে মোহিত করেছিলেন ফুটবল ভক্তদের। অবশ্য তার ক্যারিয়ারের শুরুটা এত সাবলীলভাবে হয়নি। ছিল নাটকীয়তা, ছিল বিভ্রান্তিও।
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো জন্মসূত্রে ছিলেন আর্জেন্টিনার। বাবা ডি স্টেফানো সিনিয়র একসময় ফুটবল খেলতে রিভারপ্লেট ক্লাবে। ছেলের ফুটবল প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ভর্তি করে দেন স্থানীয় একাডেমিতে। এরপর স্বয়ং রিভারপ্লেট তাদের যুব দলে নিয়ে আসে স্টেফানো জুনিয়রকে।
কিন্তু ১৯ বছর বয়সেও রিভার প্লেটের একাডেমিতেই থাকতে হয়েছিল আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে। পরে অবশ্য ধারে খেলতে পাঠানো হয় আরেক ক্লাব এটলেটিকো হারিকেনে। সেখানে সুযোগ পেয়েই বাজিমাত করেন ডি স্টেফানো। বিশেষ করে পরের সিজনে হারিকেনের সাথে রিভারপ্লেটের ম্যাচের শুরুর দিকেই গোল দেন স্টেফানো, এর পরে আরো একবার জালের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত নিজদের খেলোয়াড়ের কারণেই ম্যাচ হেরে বসে রিভার-প্লেট।
স্টেফানো’র প্রতিভার কথা বুঝতে পেরে রিভার প্লেট আর পরের বছরই তাঁকে ফিরিয়ে আনে। এসেই রাতারাতি তারকা বনে যান স্টেফানো। ১৯৪৭ সালে লিগে সেরা গোলদাতা হয়ে লিগ শিরোপা জেতান রিভার প্লেটকে। পরের বছরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
তবে ১৯৪৯ সালে আর্জেন্টিনার ফুটবলে ধর্মঘটের ছায়া নেমে এলে দেশ ছাড়েন ডি স্টেফানো। ফিফার আওতার বাইরে থাকা কলম্বিয়ান লিগের দল মিলোনারিওসে নাম লেখান এই ফরোয়ার্ড। সেখানে ৪ বছরে ৩টি ঘরোয়া লিগ জিতে নেন তিনি। ততদিনে দক্ষিণ আমেরিকার সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছিলেন কয়েক বার।
এর মাঝে রিয়াল মাদ্রিদের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সময় একটি ফ্রেন্ডলি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়। সে সময় মিলোনারিওসের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান ডি স্টেফানো। মুগ্ধ হয়ে যায় রিয়াল প্রেসিডেন্ট সান্তিয়ো বার্নাব্যু – আর তাই তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে রিয়াল। অবশ্য মাঝখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বার্সেলোনাও হাত বাড়ায় এই আর্জেন্টাইনের দিকে।
দুই ক্লাবের এই দ্বন্দ্ব পৌঁছায় আদালত এবং ফিফা পর্যন্ত। শেষ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হয় যে, ডি স্টেফানো এক বছর মাদ্রিদের হয়ে খেলবেন, আরেক বছর খেলবেন বার্সেলোনার হয়ে। কিন্তু শুরুর দিকে পারফর্ম করতে না পারায়, বার্সালোনার তৎকালীন ম্যানেজমেন্ট ৭০০০০ ডলার বিনিময়ে ডি স্টেফানোকে পুরোপুরি রিয়ালের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
মাত্র চার দিন পরেই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে বার্সেলোনার বিপক্ষে এক দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করে বসেন ডি স্টেফানো। একই সাথে সেই মৌসুমে মাত্র ৩০ ম্যাচে ২৭ গোল করে রিয়াল মাদ্রিদকে ২১ বছর পর লিগ শিরোপা এনে দেন তিনি। সবমিলিয়ে মাদ্রিদের জার্সিতে কাটানো ১১ বছরে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ৮টি লিগসহ রেকর্ড টানা ৫ ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের স্বাদ পান আলফ্রেডো ডি স্টেফানো।
এছাড়া ২৮২ ম্যাচে তিনি করেছিলেন ২১৮ গোল। এবং টানা ৪ মৌসুম লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন। তার খেলা পাঁচটি ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালেই করেছিলেন মোট ৮ গোল। ১৯৫৭ এবং ১৯৫৯ সালে মোট দুইবার ব্যালন ডি-অর জিতেছিলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে ৩৮ বছর বয়সে মাদ্রিদকে বিদায় বলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। এরপর খেলতে যান বার্সেলোনা শহরের ক্লাব এস্পানিয়লে। সেখানে দুই মৌসুম খেলার পরে নিজের বর্ণিল খেলোয়াড়ি জীবনের সমাপ্তি’র ঘোষণা দেন এই রিয়াল কিংবদন্তি।
ক্লাব ক্যারিয়ারে অফুরন্ত সাফল্য পেলেও আন্তজার্তিক ফুটবলে বড্ড দুর্ভাগা ছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, স্পেন – এই তিন দেশের হয়েই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলেছিলেন, কিন্তু কখনো বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তার। এর মাঝে ১৯৬২ সালে নিজের যোগ্যতায় স্পেনকে বিশ্বকাপে নিয়ে গেলেও ইনজুরির কারনে খেলতে পারেননি মূল আসরে।
লিওনেল মেসির মত ড্রিবলিং, টাচ আর রোনালদোর মত শট, গতি; সাথে দুর্দান্ত পজিশনিং সেন্স – একবাক্যে স্টেফানো ছিলেন এমন। স্টেফানোর আগমনের পূর্বে পঞ্চাশ বছরে মাদ্রিদেল লিগ জিতেছিল মাত্র লা লিগ দুইবার, বাকি প্রতিযোগিতাগুলোতেও ছিল না প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সামর্থ।
অথচ এখন রিয়াল মাদ্রিদ বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব, সবচেয়ে বেশি ইউরোপীয় শিরোপা তাদের দখলে, সবচেয়ে বেশি লা লিগা জেতা দলটিও তারা। আজকের এই অবস্থানে আসতে রিয়ালের যেই ‘এক্স ফ্যাক্টর’-এর প্রয়োজন ছিল সেটিই ছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। তিনি ছিলেন মাঠের অবিসংবাদিত নেতা, ছিলেন আধুনিক রিয়াল মাদ্রিদের রূপকার।
২০০০ সালে মাদ্রিদের আজীবন প্রেসিডেন্টের পদে ভূষিত করে সম্মাননা দেয়া হয় আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে। এছাড়া ২০০৬ সালে মাদ্রিদের ট্রেনিং গ্রাউন্ডের একটি স্টেডিয়ামের নাম তার নামে নামকরণ করা হয়। রিয়াল মাদ্রিদের পূর্ণতা দেওয়ার জন্য ইতিহাসে সব সময়ই উজ্জ্বল থাকবে স্টেফানোর নাম।