চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয় ফুটবল বিশ্বকাপে, যাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অব আর্থ’ বলে। ফুটবল বিশ্বকাপের মাধ্যমেই প্রকাশ ঘটেছে অনেক উদীয়মান প্রতিভার, বিশ্বকাপের মাধ্যমেই ভালো কোনো ফুটবলার নিজেকে নিয়ে গেছেন নিজেকে সেরাদের কাতারে।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ম্যারাডোনার জন্য নিজেকে প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষা ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার ২ টা স্বপ্ন ছিল।প্রথমটা,আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে খেলা এবং বিশ্বকাপ জয় করা।
১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলেও সেবার বয়স কম হওয়াতে ম্যারাডোনা সেবারের বিশ্বকাপজয়ী দলে ছিলেন না। ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলে ম্যারাডোনা জায়গা পেলেও সেবার কোয়ার্টার ফাইনালেই বিশ্বকাপ যাত্রা শেষ হয় আলবিসেলেস্তেদের, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিরুদ্ধে লাল কার্ড পেয়ে ম্যারাডোনা হোন বিতর্কিত।তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ম্যারাডোনার পুরো ক্যারিয়ার এর সবচেয়ে বড় পরীক্ষাময় অধ্যায় ছিল।
৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এবং ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ মিশন শুরু হয় গ্রুপ স্টেজে সাউথ কোরিয়া ম্যাচ এর মাধ্যমে। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জয় লাভ করে, আর্জেন্টিনার ৩ টি গোলেই এসিস্ট করেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্বের পরের ম্যাচ ছিল জায়ান্ট ইতালির বিপক্ষে। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনা প্রথমে গোল হজম করে পিছিয়ে পড়লেও এক প্রকার অসম্ভব এংগেল থেকে ম্যারাডোনার করা গোলের সুবাদে ১-১ গোলে ড্র করে আর্জেন্টিনা।
গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনার সর্বশেষ ম্যাচ ছিল বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে। ঐ ম্যাচ আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে জিতে রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত করে। ঐ ম্যাচেও ম্যারাডোনা একটি অ্যাসিস্ট করেন, তাঁর বাড়িয়ে দেয়া বলে বুরুচাগা হেড করে গোল দেন।
গ্রুপ স্টেজে আর্জেন্টিনা মোট ছয়টা গোল করে,তার মধ্যে পাঁচটা গোলেই অবদান রাখেন ম্যারাডোনা!শুধুমাত্র গ্রুপ স্টেজ শেষ হওয়ার পরই তার এসিস্ট সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় চার-এ।
বলা হয় যে একটি দিনের সূর্য দেখেই বলে দেয়া যায় দিনটি কেমন হবে, তেমনি ঐ বিশ্বকাপের গ্রুপ স্টেজ এর ম্যাচগুলোও যেন জানান দিচ্ছিলো এই বিশ্বকাপটা শুধুই ম্যারাডোনার হবে, পুরো বিশ্বকাপই ম্যারাডোনাময় হবে।
রাউন্ড অফ সিক্সটিন এ আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে। ম্যাচটি আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে জিতে। এই ম্যাচে ম্যারাডোনার গোল বা এসিস্ট ছিল না, কিন্তু ঐ যে, কিছু কিছু খেলোয়াড় আছেন যারা গোল এসিস্ট না করেও ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে- ম্যারাডোনা তাদেরই একজন। ম্যারাডোনার বাড়িয়ে দেওয়া বলেই আর্জেন্টিনার ঐ একমাত্র গোলের বিল্ড আপ শুরু হয়।
এরপরই আসে সেই ঐতিহাসিক আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ড ম্যাচ। ঐ ম্যাচের কথা আমরা কম বেশি সবাই জানি। মেক্সিকোর আজটেকা স্টেডিয়ামে সেদিন ১০০০০ মানুষ সমবেত হয়েছিলেন আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ড এর সেই ম্যাচ দেখতে।ম্যারাডোনা দর্শকদের হতাশ করেন নিই, খুব সম্ভবত ঐ বিশ্বকাপের সবচেয়ে সেরা পারফরম্যান্স ম্যারাডোনা ঐ ম্যাচের জন্যই তুলে রেখেছিলেন।
আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড কে হারায়। ঐ ম্যাচে দুটি গোলই ম্যারাডোনার ছিল। এর মধ্যে প্রথম গোলটি হাত দিয়ে করা সেই আলোচিত ‘হ্যান্ড অব গড। দ্বিতীয় গোলটা তার চাইতেও বেশি আলোচিত ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ – কারো কারো মতে এখন পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বকাপের, ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা গোল।
ইংল্যান্ডের ৪ জন ফুটবলারকে কাটিয়ে গোলকিপার পিটার শিল্টনকে ফাঁকি দিয়ে দেয়া ঐ গোল যারা লাইভ দেখেছিলেন তারা হয়তো এর চাইতে সুন্দর কিছু জীবনে কখনোই দেখেন নিই। বলা যায়, মোটামুটি ম্যারাডোনার একক নৈপুণ্যেই বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে পৌছায় টিম আর্জেন্টিনা।
সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল বেলজিয়াম। আর্জেন্টিনা জিতলো ২-০ গোলে,এর মধ্যে একটি গোল ম্যারাডোনার। তাও গোলটি তেমন সাধারণ গোল না,তার অন্যান্য গোলগুলোর মতো এই গোলও ছিল ফুটবল শিল্পের প্রতিচ্ছবি। ডি বক্সের বাইরে থেকে চারজন বেলজিয়ান কে কাটিয়ে গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনা চলে গেলো ফাইনালে। ঐ ম্যাচের পর দেশ বিদেশের সব দৈনিক পত্রিকার শিরোনামের মূলভাব হয়তো এটাই ছিল, ‘এক ম্যারাডোনায় চড়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা’।
অবশেষে এলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ফাইনাল। ঐ ফাইনালের জন্য পুরো বিশ্বের ফুটবল ফ্যানদের চাইতে হয়তো ম্যারাডোনার প্রতীক্ষা কয়েক গুণ বেশি ছিল। কারণ ঐ যে, ম্যারাডোনা শৈশব দুটো স্বপ্নই দেখতেন, প্রথমটি হলো আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে খেলা এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া। আজ তার আর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাঝে মাত্র ১ ম্যাচের দূরত্ব। বাকি ম্যাচগুলোর মতো এই ম্যাচটিও যদি নিজের করে নেন তাহলেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ হবে।
অবশেষে ফাইনাল ম্যাচ শুরু হলো। সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার লোথার ম্যাথিউস ম্যাচের পুরোটা সময় ম্যারাডোনা কে মার্ক করে রেখেছিলো। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয় নিই,কারণ ম্যারাডোনারা কখনো হার মানেন না। শত বাধা উপেক্ষা করে যারা বিজয়ী হিসেবে মাঠ ছাড়ে তারাই যে ম্যারাডোনা!
সেই ম্যাচে ম্যারাডোনা একটি অ্যাসিস্ট করেন, কিন্তু সেই একটি অ্যাসিস্ট হয়তো ম্যারাডোনার পুরো বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স এর চাইতে সবচেয়ে বেশি দামী কারণ তাঁর বাড়িয়ে দেয়া সেই বলেই বুরুচাগা গোল করে ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেন। আর্জেন্টিনা জিতে যায় ৩-২ গোলে, দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ ঘরে উঠে আর্জেন্টিনার। ম্যারাডোনাময় একটি বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে ম্যারাডোনার হাতে বিশ্বকাপ উঠার মাধ্যমেই!
এবার আসা যাক আরো কিছু পরিসংখ্যানে।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ১৪ টি গোল করে, তার মধ্যে পাঁচ গোল এবং পাঁচ অ্যাসিস্ট করে ১০ গোলে অবদান রাখেন ম্যারাডোনা,শতকরা হিসাব করলে আর্জেন্টিনার গোলগুলোর ৭১% গোলেই ম্যারাডোনার অবদান ছিল। ঐ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা যতগুলো শট নেয় বা চান্স ক্রিয়েট করে তার ৫২% ই ম্যারাডোনার পা থেকে এসেছিলো। ঐ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ৯০ টি ড্রিবল সম্পন্ন করেন,যা ঐ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ছিলো।
এমন অতিমানবীয় পারফরম্যান্স এর পর যে ম্যারাডোনা ঐ বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল পাবে সেটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, তবে মজার বিষয় হলো আর দুই গোল করলেই ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকারকে টপকে সেবার গোল্ডেন বুটও জিতে নিতে পারতেন ম্যারাডোনা।
কারো কাছে ৮৬ বিশ্বকাপ মনে থাকবে ম্যারাডোনার সেই হাত দিয়ে দেয়া গোলের কারণে, কারো কাছে ৮৬ বিশ্বকাপ মনে থাকবে ম্যারাডোনার দেয়া সেই সর্বকালের সেরা গোলের কারণে, কারো কাছে ঐ বিশ্বকাপ মনে থাকবে ম্যারাডোনার ক্যারিয়ার এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কম্পলিট করার বিশ্বকাপ হিসেবে। কিন্তু সবাই ঐ বিশ্বকাপকে ‘ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ’ হিসেবে মনে রাখতে বাধ্য। এমনটা বোধহয় ফুটবল ইতিহাসে কখনো দ্বিতীয়বার হয় নি যে একটি বিশ্বকাপের পুরো লাইমলাইট একজন খেলোয়াড় নিজের পারফরম্যান্স এর মাধ্যমে নিয়ে গেছেন।