ফিনিশড নন, ফিনিশার কার্তিক!
বছর তিনেক আগে ২০১৯ সালে এক টুইট বার্তায় ভারতের তারকা স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন বলেন, ‘গেল ১৮ মাস ধরে বেশ ভাল ফর্মে আছেন কার্তিক। যদি সে বর্তমানের সেরা ফিনিশারও বনে যায় তাহলেও অবাক হবো না।’
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) আগের দুই আসরের হতশ্রী ব্যাটিং পারফরম্যান্সে সমালোচনার বৃত্তে ছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটার দীনেশ কার্তিক। টানা ব্যর্থতায় দল থেকে বাদ দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর) সমর্থকরা। ব্যর্থতার সাগরে ভাসতে ভাসতে অবশেষে তীরে ঠাঁই পেলেন কার্তিক। আইপিএলের এবারের আসরে এখন পর্যন্ত ব্যাট হাতে দেখা গেছে ভিন্ন কার্তিককে!
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর (আরসিবি) জার্সিতে তিন ম্যাচেই ব্যাট হাতে খেলেছেন ঝড়ো ইনিংস। সবশেষ রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ের দিনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় কার্তিকের ব্যাট। ২৩ বলে ১ ছক্কা ও ৭ চারে দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলে জয় এনে দেন কার্তিক।
রাজস্থান রয়্যালসের দেওয়া ১৭০ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে মাত্র ৮৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যাঙ্গালুরুর ব্যাটিং শিবির। এরপর ষষ্ঠ উইকেটে শাহবাজ আহমেদের সাথে ৩২ বলে ৬৭ রানের তাণ্ডবময় জুটির পথে জয়ের ভিত গড়ে দেন কার্তিক। শাহবাজ ২৬ বলে ৪৫ রানে ফিরলেও ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন এই তারকা।
২০২০ আইপিএলে ১৪ ম্যাচে মাত্র ১৪ গড়ে করেছিলেন ১৬৯ রান! কলকাতা নাইট রাইডার্সের ভরাডুবির মৌসুমে অধিনায়ক হিসেবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন কার্তিক। ব্যাট হাতে ছিল চরম বাজে পারফরম্যান্স। কার্তিককে বাদ দিতে সমালোচনার কোনো কমতি ছিল না সমর্থকদের। এরপর সমালোচনার মুখে টুর্নামেন্টের মাঝপথেই অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে তিনি সরে দাঁড়ান। পরের আসরে ২০২১ সালে অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বে না থাকলেও ব্যাট হাতে সফলতার আলোটা খুঁজে পাননি কার্তিক। ১৭ ম্যাচে ২২ গড়ে করেছিলেন মাত্র ২২৩ রান।
২০২২ আইপিএলের মেগা নিলামের আগে কার্তিককে ছেড়ে দেয় কলকাতা। আইপিএলের ১৫তম আসরের মেগা নিলামে ৫.৫০ কোটি রুপিতে কার্তিককে দলে ভেড়ায় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু। নতুন জার্সিতে নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন কতটুক তা নিয়েও ছিল সংশয়। অবশ্য জার্সিটা নতুন হলেও কার্তিকের জন্য দলটা বেশ পুরনো। ২০১৫ আইপিএলে ব্যাঙ্গালুরুর হয়েই খেলেছিলেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। সেবার ১০.৫ কোটি রুপিতে চড়ামূল্যে আরসিবি কিনে নেয় কার্তিককে। কিন্তু দাম অনুযায়ী নিজের সামর্থ্যের সিঁকিভাগও দিতে পারেননি তিনি। ১৬ ম্যাচে মাত্র ১৩ গড়ে করেছিলেন ১৪১ রান!
সাত আসর পর আবারও ব্যাঙ্গালুরুর জার্সি গায়ে ফিরেছেন তিনি। তবে এবার আগের চেয়ে আর্ধেক দামে। কিন্তু পারফরম্যান্সটা আগের চেয়ে দ্বিগুন ভাল। পুরনো দলে নতুন রূপেই ফিরেছেন তিনি। আর এবারের রূপটা এখন অবধি যেন আগের কয়েক আসরের চেয়েও ভয়ংকর!
এবারের আসরে প্রথম ম্যাচে পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১৪ বলে ৩২ রানের ঝড়ো ইনিংস। পরের ম্যাচে কলকাতার বিপক্ষে খেলেন ৭ বলে ১৪ রানের ক্যামিও। সবশেষ রাজস্থানের বিপক্ষে ২৩ বলে ৪৪ রানের ঝড়ো ইনিংস! এবারের আসরে এখন পর্যন্ত কার্তিকের ব্যাটিং গড় শূন্য! হ্যাঁ, শূন্য। কারণ এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচের একটিতেও আউট হননি তিনি। তিন ম্যাচে ২০৫ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৯০ রান! ফিনিশার হিসেবে ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে এখন পর্যন্ত ব্যাট হাতে উড়ন্ত ফর্মে আছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার।
বছর তিনেক আগে ২০১৯ সালে এক টুইট বার্তায় ভারতের তারকা স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন বলেন, ‘ গেল ১৮ মাস ধরে বেশ ভাল ফর্মে আছেন কার্তিক। যদি সে বর্তমানের সেরা ফিনিশারও বনে যায় তাহলেও অবাক হবো না। ‘
সেবার ঘরোয়া ক্রিকেটে উড়ন্ত ফর্মে ছিলেন কার্তিক। সেখান থেকে সুযোগ পেয়ে যান ২০১৯ বিশ্বকাপেও। যদিও বিশ্বকাপের মঞ্চে ব্যাট হাতে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। দুই ম্যাচে করেন মোটে ১৪ রান! এরপরই বাদ পড়েন দল থেকে। এরপর ২০১৯-২০ মৌসুমে অধিনায়ক হিসেবে নিজ দল তামিলনাড়ুকে ফাইনালে তুলেন কার্তিক। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ ধোনির মত ফিনিশার হবার লক্ষ্যতেই কাজ করছেন তিনি। ‘
গেল দুই আসরের হতশ্রী পারফরম্যান্সে অনেকেই ভেবেছিলেন ফুরিয়ে গেছেন কার্তিক। তবে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে কার্তিক জানান দিলেন ফিনিশার হিসেবে তিনি এখনও অনেকের চেয়ে সেরা। ২০১৮ সালের পর থেকে কমপক্ষে ৫০০ রান করা ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে বিরাট কোহলির ২০৬.৪৭ ও হার্দিক পান্ডিয়ার ১৯৩.৫৬ স্ট্রাইক রেটের পর তৃতীয়তে আছেন কার্তিক! ডেথ ওভারে গেল তিন বছরে তাঁর গড় স্ট্রাইক রেট ১৮৮!
আইপিএলের আগে চেন্নাই থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে থেনিতে এক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে খেলেন কার্তিক। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জয়পুরে বিজয় হাজারে ট্রফির ফাইনালেও করেন সেঞ্চুরি। কার্তিকের লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে স্কোয়াডে জায়গা করে নেওয়া।
আইপিএলে তাঁর উড়ন্ত সূচনা প্রমাণ করে তিনি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সর্বোচ্চটাই দিচ্ছেন। এখনও টুর্নামেন্টের অনেক পথ বাকি। তবে টুর্নামেন্ট শেষে কার্তিকের পরিসংখ্যানই হয়তো বলে দিবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য তাসমান পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ার বিমানে তিনি উঠতে পারবেন কিনা!