সেই রাতের মতো বার বন্ধ করে দিতে চাইছেন ম্যানেজার, কিন্তু পারছেন না। পারবেন কিভাবে? বারের কোণার দিকে একটা টেবিলে তখনো এক লোক মদ গিলে যাচ্ছেন, গিলে যাচ্ছেন সেই অনেক আগে থেকে।
তা এত মদ গেলার কারণ কি? বুকভরা কষ্ট? উহু, একদমই না। এত মদ গেলার কারণ, বারে আসার আগে তিনি টেস্টে নিজের ১৪ তম সেঞ্চুরিটি করে এসেছেন, মাঠ ছেড়েছেন অপরাজিত থেকে। সেই সেঞ্চুরিটা সেলিব্রেট করতেই এই মদে ডুব দেয়া। বারের ম্যানেজার কি আর করবেন? অগত্যা টিম ম্যানেজারকে ডাকা হলো তাদের এই ক্রিকেটারকে ধরে নিয়ে যেতে। তার মদ খাওয়ার গল্পগুলো এতটাই কিংবদন্তিতুল্য যে তাঁর নামে ওয়াইনের একটা ব্র্যান্ডও আছে!
তিনি হলেন ডগ ওয়াল্টার্স। পুরো নাম কেভিন ডগলাস ওয়াল্টার্স।
অবশ্য বোতলের পর বোতল মদ শেষ করেও মাতাল না হবার ‘গুণ’ সেই ব্যাটসম্যানের ছিল। মদ খাওয়ার মতোই দক্ষ ছিলেন ব্যাটিংয়েও। ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’ কথাটা ক্রিকেটে তার চেয়ে বেশি বোধহয় কারো ক্ষেত্রেই খাটে না। এই যেমন আগের রাতে মদে চুর হয়েও পরদিন মাঠে নেমে সেই সেঞ্চুরিটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ২৫০ পর্যন্ত, আট নম্বর ব্যাটসম্যান গ্যারি গিলমোরের সাথে বেঁধেছিলেন ২১৭ রানের জুটি।
প্র্যাকটিস করতে খুব একটা পছন্দ করতেন না, মদের পাশাপাশি নেশা ছিল সিগারেট আর তাস খেলার। পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে তার নামার কথা, অথচ তিনি তাস খেলায় ব্যস্ত – এমন ঘটনাও আছে। কিন্তু ব্যাট হাতে মাঠে নামলেই তিনি অন্য মানুষ। অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন, এরপর একে একে করেছেন আরো ১৪ টি সেঞ্চুরি।
৭৪ টেস্টে ৪৮.২৬ গড়ে ৫৩৫৭ রান। ডেনিস লিলি নিজের এই সতীর্থের ব্যাটিং সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আগ্রাসী ব্যাটিং বিবেচনায় আমি তাকে ভিভ রিচার্ডসের সমকক্ষ মনে করি। ভিভেরটা ছিল নির্মম আগ্রাসন, কিন্তু তার ছিল অসাধারণ শটমেকিং এবং প্লেসমেন্ট দক্ষতা।’
ওয়াল্টার্সের মান কেমন ছিল – তা বুঝতে লিলির এই বক্তব্যটাই যথেষ্ট!
বল হাতে ২৯ গড়ে ৪৯ উইকেট হয়তো খুব বেশি মনে হবে না, কিন্তু এই ৪৯ উইকেটের বেশিরভাগই এসেছে দলের খুব প্রয়োজনের মুহুর্তে। পার্টটাইম বোলারের চেয়ে একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তিনি।
ব্যাটিং দক্ষতার জন্য তাকে ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টায় বলা হতো ‘আদার ব্র্যাডম্যান’। কিন্তু স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সাথে এই তুলনাটায় তাঁর ভয়াবহ আপত্তি ছিল। ডনকে প্রচন্ড শ্রদ্ধার চোখে দেখেন, তাই এই তুলনায় বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন – ‘ব্র্যাডম্যান শুধুই ব্র্যাডম্যান। কে কি বললো সেটা আমার কাছে বিন্দুমাত্র অর্থ বহন করে না। ব্র্যাডম্যানের মতো হবার ব্যাপারে আমি ভাবিও না কখনো।’
আরো পড়ুন
- ‘কালা আদমি’র মানকাডিং!
- স্লেজিং ও অস্ট্রেলিয়া: একটি ভালবাসার গল্প
- তিন অধিনায়ক, তিন যুদ্ধ
- সেই ভারত, এই ম্যাকডারমট!
- তারা যখন ম্যাচ সেরা!
শচীনের সাথে ব্র্যাডম্যানের তুলনাটাও তার কাছে বিরক্তির ব্যাপার। এই তুলনাটার জবাবটা তার চেয়ে ভালো আর কেউই বোধহয় দিতে পারেননি – ‘একজনের গড় প্রায় ১০০, আরেকজনের ৫৩। তুলনাটা ঠিক আসে কিভাবে?’
প্রচণ্ড ঠোঁটকাটা বলে পরিচিত এই মানুষটা একটু খোঁচাও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দাদুর প্রতি নাতির যে অপত্য স্নেহ কাজ করে, ব্র্যাডম্যানও শচীনকে সেরকম স্নেহ করতেন। আর সেই স্নেহ থেকেই তিনি বলেছিলেন যে শচীন তার মতো ব্যাট করে।’
তাঁর জীবনী লেখক অ্যাশলে ম্যালেট তাকে বর্ণিত করেছেন এভাবে – ‘তাঁর মধ্যে কোন ভণিতা ছিল না। সে এমন একজন মানুষ, যে তার জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করেছে। ক্যারিয়ার জুড়ে সে কয়েকটা জিনিসকেই ভালোবেসেছে – বিয়ার, সিগারেট, বাজি এবং তাঁর ব্যাট।’
ব্যাটসম্যান হিসেবে ভিভের সাথে তুলনীয় হলেও মানুষ হিসেবে ডেনিস লিলির চোখে তিনি ছিলেন অতুলনীয় – ‘তাকে আমি কোনদিন ব্যাট ছুঁড়ে মারতে দেখিনি, কোনদিন কারো সাথে বাজে ব্যবহার করতে দেখিনি। সে ছিল খুব শান্ত একজন মানুষ। তার মতো কেউ আর ক্রিকেটে আসবে না।’
সত্যিই তাই, ডেনিস লিলির কথাই সত্যি হয়েছে। তাঁর মত আর কেউ আসেনি। ভবিষ্যতেও আসবে কি না সন্দেহ!