‘আমার মতো শুরু যেন কারও না হয়’

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইতে দাপুটে পারফরম্যান্সের পর এবাদত হোসেন জানিয়েছেন এই সাফল্যের পেছনে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৬ রানে ৬ উইকেট শিকারের পথে একাই নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং শিবির ধসিয়ে দেন এই পেসার। ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হওয়ার পর এবাদত ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ক্যারিয়ারের এই পথ পাড়ি দিয়ে আজকের পর্যায়ে আসার কথা।

২০১৬ তে পেসার হান্ট থেকে উঠে এসে অনেক লম্বা পথ পথ এসেছেন…

– ২০১৬ পেসার হান্টে আমি গতিতারকা হিসেবেই উঠে এসেছিলাম। বিসিবি আমাকে ৩ বছরের জন্য হাই পারফরম্যান্স ইউনিটে রাখে। তারা আমাকে অনুশীলন করায়। আমি এ দলে খেলেছি, বিসিবি একাদশে খেলেছি এরপর এই পর্যায়ে এসেছি।

প্রথম টেস্টে ৪৬ রানে ৬ উইকেট পাওয়ার নেপথ্যে কি ছিল?

– আমি মনে করি আমাদেরকে পেছনে ফিরে যেতে হবে। আমরা ১০ দিন কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম। প্রথম অনুশীলনের আগে আমাদের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন স্যার সবাইকে বললেন, ‘ আমরা গত ২১ বছরে নিউজিল্যান্ডে কোনো ম্যাচই জিতেনি। তার মানে আমরা কি সবসময়ই এখানে হারবো? একটা দলের এখানে জয়ের দরকার। আমি মনে করি এটা বাংলাদেশের সেরা দল। এবং এই দলটাই নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ইতিহাস গড়তে পারে।

এই কথাগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমি নিজে চিন্তা করেছি। এখানে কাউকে তো জিততে হবে। এটা আমাদের গ্রুপটাই হওয়া উচিত। আমাদের অধিনায়ক মুমিনুল হক ভাই, মুশফিক ভাই এবং লিটন দাসও অনেক কিছু বলেছে। মোটিভেশন যে কাজ করেছে এই ম্যাচই তার প্রমাণ। আমি নিজেকে বলেছি যে আমরা নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পেতে পারি। টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। যদি আমরা আমাদের সেরাটা দিতে পারি, কেউ আমাদের হারাতে পারবে না।

চতুর্থ দিনে আমাদের দ্বিতীয় স্পেলের সময় আমার টিমমেটরা যেভাবে সাপোর্ট করেছে আমি মনে করি আমি যা চাইতাম বলের সাথে তাই করতে পারতাম। অধিনায়ক আমাকে বলেছে, ‘নিজের সেরাটা দিয়ে যাও, আমরা তোমার সাথে আছি।’ আমি আর পেছন ফিরে তাকাইনি, প্রতিটা বল ১৪০+ গতিতে করেছি।

আপনি একটা নির্দিষ্ট লেন্থে বল করে গেছেন। কিন্তু আপনি দুই স্পেলেই টানা ১৪০+ গতিতে বল করে গেছেন চতুর্থ দিনে!

– পেসার হিসেবে যদি আপনি ফিট থাকেন, তাহলে আপনি যেকোনো কিছু করতে পারবেন। একজন পেসারের জন্য ফিটনেসটা সবচেয়ে বড় বিষয়। পাকিস্তান সিরিজের আগে চারটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলাম। এটাই প্রস্তুতি হিসেবে নিয়েছি। আমি আমার শারীরিক ফিটনেস ও মানসিক অবস্থা উন্নতি করতে চেয়েছি। আমি পাকিস্তানের বিপক্ষেও ভালো বোলিং করেছি।

আমরা অনুশীলনে যাওয়ার আগে তিনদিন আমাদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা। কিন্তু আমরা দশ দিন কোয়ারেন্টাইনে ছিলাম। আমরা রানিংটা করতে পারিনি তবে বিসিবি আমাদের রুমে ফিটনেস ট্রেনিংয়ের জন্য বেশ কিছু জিনিস দিয়েছিলো। আমি চেষ্টা করেছি ফিটনেস ধরে রাখতে। কন্ডিশনিং কোচ নিক লি এবং ফিজিও বায়েজিদ ভাই আমাদেরকে অনেক সাহায্য করেছে। যার কারণে ৬ পেসারই ফিট ছিলো।

আপনার দিক থেকে কোন বিষয়টা মাউন্ট মঙ্গানুইতে আপনার মধ্যে পরিবর্তন এনেছে?

২০১৯ সালে টেস্ট অভিষেকের পরেও আমি নিজের সেরাটা দিতে পারিনি। অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছি। আমি ২ বছর ধরেই পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসনের সাথে কাজ করেছি। সে সবসময়ই আমাকে উৎসাহিত করেছে। সে বলেছে ‘ তুমি দুই দিকেই বল স্যুইং করানোর সামর্থ্য রাখো। ‘ বল রিলিজ পজিশনে তুমি সেরা অবস্থানেই আছো বাংলাদেশের মধ্যে। আত্মবিশ্বাস ছাড়া তোমার মধ্যে সবকিছুই আছে। যেদিন তোমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আসবে, তুমি দেশের সেরা বোলার হতে পারবে।

সে আমার বোলিংয়ে পরিবর্তন নিয়ে আসে। পুরোনো অ্যাকশনে আমি আমার শক্তি হারিয়ে ফেলতাম পরের স্পেলে। গিবসন আমার অ্যাকশনে পরিবর্তন আনে। কম এফোর্টে আমাকে আরো গতিতে বল করার পরামর্শ দিলো।আমার অ্যাকুরেসিও অনেক উন্নতি হলো। সে টিম মিটিংয়ে বলেছে ‘ আমি আজকে পারফেক্ট এবাদতকে দেখেছি। সে বুঝতে পেরেছে তাকে কি করতে হবে। সে এটা সামনেও ধরে রাখবে। ‘

অধিনায়ক মুমিনুল হক বলেছেন যে আপনি তখনি জিততে পারবেন যখন আপনার বোলাররা বেশ ভালো করবে। যখন আপনি চতুর্থ দিন বিকেলে তিন উইকেট শিকার করলেন তখন মুমিনুল অনুভব করেছেন বাংলাদেশ হয়তো ম্যাচটি জিতবে।

– সব সাফল্যের পেছনেই অনেক কিছু থাকে। বাইরে থেকে সবাই খুব সহযোগিতা করেছে। নাজমুল শান্ত স্লিপ থেকে আমাকে বলছিলো জোরে বল করতে থাকো। অধিনায়ক ও মুশফিক ভাই বলেছে বোলাররা ভালো বল করছে, তাদেরকে সাপোর্ট করো। তাসকিন আমাকে বলছিলো পরিকল্পনা কাজে দিচ্ছে। আমরা ম্যাচটা জিতবো। বিশ্বাস করুন, সবার সাপোর্ট আমাকে আরো উত্তেজিত করে তুলে। আমি এই টেস্টে জেতাতে আমার ১২০% দিয়েছি। আমি স্টাম্প বরাবর গতি ধরে রেখে বল করে গিয়েছি। বল বেশ ভালো রিভার্স করছিলো! এটা সত্যি অবিশ্বাস্য।

পঞ্চম দিনে রস টেলরের উইকেটটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আগের দিন দুইবার জীবন পেয়েছে। আপনি তাঁকে আরো ইনসুইঙ্গার দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন?

– রস টেলরের উইকেট নেওয়া মানে তাদের টেইলএন্ডারদের জন্য বড় স্কোর করা বেশ দুরুহ। আমাকে সকাল বেলা সেরা বোলিংটাই করতে হবে জানতাম। আমি প্রথম বল দেখলাম কিছুটা ভিতরে ঢুকলো। আমি সর্বশক্তি দিয়ে পরের বলটা করলাম এবং এটা দারুনভাবে রিভার্স স্যুইং হলো আর তাকে আউট করলাম।

চতুর্থ দিনের শেষদিকে রসের সাথে আপনার কিছুটা কথোপকথন হয়েছিলো। কি বলেছিলেন সেখানে?

– আমি তাঁকে বলেছিলাম তুমি খুব ভালো মারতে পারো, কেন তুমি আমাকে মারছো না। সে আমাকে বলে, ‘ভাই, তুমি যদি এই পিচে এভাবে বোলিং করো কেউই তোমাকে মারতে পারবে না।’

টেলরের উইকেটের পর শরিফুল ইসলামের ক্যাচ নিয়ে কি বলবেন?

– সত্যি অবিশ্বাস্য একটা ক্যাচ। তাইজুল ভাই এবং সাদমান সবাই দুর্দান্ত ক্যাচ ধরেছে। আমরা ভালো ফিল্ডিং করেছি। আমরা খুব ভালো অনুভব করছিলাম। আমি মনে করি এই জয় প্রমাণ করেছে আমরা যেকোনো দলকে হারাতে পারি।

পেস বোলিং বিভাগের সবার মাঝেই দারুন বোঝাপড়া ছিলো?

আমরা একজন আরেকজনের সাথে অনেক কথা বলেছি। তাসকিন যখন বল করছিলো সে দুর্দান্ত একটা বল করে। আমি তাকে বলেছিলাম মিড অন থেকেও এটা খুব অসাধারণ দেখাচ্ছিলো। তাসকিনও আমাকে উৎসাহিত করছিলো। সে আমাকে সম্প্রতি বলেছে আমরা একসাথে ১১ মাস আছি। আমরা যদি এভাবে পরিবারের মতো থাকতে পারি আমরা একসাথে অনেক কিছু করতে পারবো।

আপনার বিমানবাহিনীর ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। আমি সেলিব্রিটি স্যালুট নিয়ে বলছি না, তবে একজন বিমানসেনা হিসেবে আপনাকে ফিট থাকতে এবং ডিসিপ্লিন থাকতে সাহায্য করে অবশ্যই?

– এটা ভিন্নরকম একটা জীবন। তারা খুবই ডিসিপ্লিনড। এটা আমাকে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক সাহায্য করেছে। আমি সবসময়ই এটা মনে রাখি। এটা আমাকে স্মরণ করায় আমি দুই দিক থেকেই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি।

এই টেস্টের আগে আপনি কি আপনার বোলিং গড় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন?

আমার মতো কেউ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এভাবে শুরু করুক সেটা আমি চাইনা। আমি খুব স্ট্রাগল করেছি। আমি ওটিসকে বলেছিলাম একটা উইকেটও সহজে পাচ্ছিনা আমার প্রতিটা উইকেটের জন্য খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি মাঝে মাঝে ১৭ অথবা ২২ ওভার পরেও উইকেট পেয়েছি। এমনও আছে এক টেস্টে ১ উইকেট পেয়েছি! তিনি হেসে আমাকে বললেন, ‘ বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্বাগতম। এই কন্ডিশন তোমার পক্ষে নয়। ‘

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link