ওগো অশ্রুবিজয়ী…

২৬ বছর আগের এক সকাল। নিউজিল্যান্ডের তাউরাঙা শহরের কাউচের উপর শুয়ে আছেন ব্রেট উইলিয়ামসন, আর তার পাশে ব্যাট বল হাতে ছোট্ট কেন্ তার বাবাকে বলছে – ‘বাবা, একটু বল করবে?’ - যেন শান্ত অথচ একাগ্র, আত্মবিশ্বাসী অথচ অহংকারহীন ভাবলেশহীন একটা ছেলে যারমুখে সদা লেগে আছে মিষ্টি হাসি। যেন প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে একটা অজানা দ্বীপ,শত ঢেউয়ের গর্জনেও যে স্থির সন্ন্যাসীর মতো ধ্যানমগ্ন।

তিনি হাসছেন – হাসিটা বিজয় উল্লাসের নয়, হাসিটা তখনকার, যখন বেন স্টোকসের ব্যাটে বল লেগে ওভার থ্রোয়ের জন্য অতিরিক্ত চার রান উপহার পেল ইংল্যান্ড। সম্ভাব্য শেষ জেনেও হেসে চলেছে বাদামী দাড়ির সেই সন্ন্যাসী। যেন ভাবলেশহীন হাসতে হাসতে আপনমনে বলে চললেন-

নতুন তবু কি দুঃখের কথা? -নব সে আবিস্কার?

কপিল কণাদ বুদ্ধেরও পরে আছে কিছু বলিবার?

২৬ বছর আগের এক সকাল। নিউজিল্যান্ডের তাউরাঙা শহরের কাউচের উপর শুয়ে আছেন ব্রেট উইলিয়ামসন, আর তার পাশে ব্যাট বল হাতে ছোট্ট কেন্ তার বাবাকে বলছে – ‘বাবা, একটু বল করবে?’ – যেন শান্ত অথচ একাগ্র, আত্মবিশ্বাসী অথচ অহংকারহীন ভাবলেশহীন একটা ছেলে যারমুখে সদা লেগে আছে মিষ্টি হাসি। যেন প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে একটা অজানা দ্বীপ,শত ঢেউয়ের গর্জনেও যে স্থির সন্ন্যাসীর মতো ধ্যানমগ্ন।

ইনি কেন উইলিয়ামসন। এমন একটা নাম যিনি পাদপ্রদীপ থেকে অনেক দূরে। অধিনায়ক, কিন্তু কোনো টুইটার অথবা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই। যেন পৃথিবী থেকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো এক তারা যিনি দূর থেকে অপেক্ষায় বসে আছেন নিজের জন্য না, সতীর্থের আনন্দে আনন্দিত হবার জন্য।

সালটা তখন ২০০২, কেনের বয়স তখন ১২ বছর। স্কুলের খেলায় ক্রিকেট কোচ স্বয়ং তাঁর বাবা একটা ম্যাচে অন্যদের সুযোগ দেবার জন্য আট নম্বরে নামালেন কেনকে, সতীর্থরা ব্যর্থ হয়েছিল, কেন নিজে অপরাজিত থেকে ম্যাচ জেতালেন, কিন্তু কোনো উচ্ছ্বাস নেই, আগে ১১ নম্বরে ব্যাট করা সতীর্থটিকে এগিয়ে দিলেন সেলিব্রেশনে আর নিজে রইলেন দূরে আর মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই গড গিফটেড হাসিটা।

শুধু কি ক্রিকেট? কেন্ উইলিয়ামসন এমনই এক চরিত্র যিনি যে খেলাই খেলুন না কেন, ম্যাচের মধ্যে ঢুকে যান, এমন কথাই জানিয়েছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু সাবেক ক্রিকেটার ডগ ব্রেসওয়েল। তিনি কেন্ উইলিয়ামসন, রাগবী খেলার এক দু্র্দান্ত ফ্লাই হাফ ছিলেন, কিন্তু ঘটনার চক্রে ক্রিকেটেই প্রবেশ করল সেই সন্ন্যাসী।

ছোটোবেলা থেকেই প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে তার মিত্রতা, অথচ ঢেউয়ের গর্জন নেই, আছে স্নিগ্ধতা। যিনি ব্যাট করলে মনে হয় কেউ হয়তো গ্রামাফোনে কোনো ধ্রুপদী সঙ্গীতের ভৈরবী রাগ বাজিয়ে চলেছে যেটা শান্ত অথচ সুন্দর, ঘন্টার পর ঘন্টা যেন শুনেই যেতে ইচ্ছে হয়, যেন কোনো গাড়ির ড্রাইভার পাহারের খাদ বেয়ে সমস্ত ধ্বসকে তুচ্ছ করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িটাকে আর বিপদের মাঝেও ঠোঁটটা রেঙে উঠেছে সেই অশ্রুবিজয়ী হাসি।

তিনি উইলিয়ামসন, হৃদয়বিদরণের পরেও তার চোখ থেকে অশ্রুবিসর্জন হয়নি, মার্টিন গাপটিলের থ্রোতে বিজয় কেতন উড়লেও তিনি আবেগে বিস্ফোরিত হননি। শেষ বলে চার দরকার, তিনি ছয় মেরে ম্যাচ জেতালেন, তাও আবার মিশেল স্টার্কের বলে, পূরণ করলেন সেঞ্চুরি, অধিনায়ক ম্যাককালাম উচ্ছাসে ফেটে পড়ছেন, কিন্তু কেনসাহেব তখনও শান্ত।

ঠিক যেন আপনার পাশের বাড়ির ছেলে যার সাথে রোজ বিকালে আপনার ছেলে খেলা করে, অথবা এক অচেনা খ্রিস্টান সাধু যে রোজ হাসিমুখে আপনার বাড়িতে আসে শুধু মায়ের হাতে একটু ডালভাত খেতে। তাঁর চাহিদা যে খুবই সামান্য। লর্ডসের স্বপ্নভঙ্গের রাতেও যাঁর মুখে হাসি, যেন Rudyard Kipling তার মুখেই আউরে চলেছেন – ‘If you can meet triumph and disaster and treat those imposters Just the same।’

যেন ক্রিকেট মহাকাব্যের একটা উপসংহারের পাতা, যেটা লিখতে সবচেয়ে কম কালি খরচ হয় কিন্তু যেটা না থাকলে মহাকাব্যটাই অসম্পূর্ণ। ওই দেখো, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপটা তুলে নৃত্য উৎসবে স্যাম্পেনের ফোয়ারা ছোটাচ্ছে, তখনও দাঁড়িওয়ালা সন্ন্যাসীটি মৃদু স্বরে আওড়াচ্ছেন – ‘Yours is the earth & everything that’s in it, and which is more – You’ll be Man, my son.’

আর ঠোঁটে লেগে আছে সেই ভাবলেশহীন হাসিটা, সেটা যে বড়োই রহস্যময়ী। সত্যিতো নাই বা থাকুক বিশ্বকাপ, বিশ্বটাই তো আজ উইলিয়ামসনের — ‘Yours is the earth and everything that’s in it.’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...