ওপেনার থেকে ম্যাচ রেফারি

সাল ২০০৫। ১৮ বছর পর অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে অ্যাশেজ ট্রফি জয় করলো ইংলিশরা। সেই যে ৮৭ সালে জয় পেয়েছিলো ইংল্যান্ড, এরপর ১৮ বছর ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তি অজিদের বিপক্ষে অ্যাশেজে ইংলিশরা বার বার ধরাশায়ী হচ্ছিলো। ১৯৮৭ সালের সবশেষ অ্যাশেজ জয়ের নায়কটা ছিলেন ইংলিশ ওপেনার ক্রিস ব্রড। ইংলিশ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রডের বাবা হিসেবে ক্রিসের পরিচিতি বেশি হলেও ক্রিস ব্রডের নিজস্ব খ্যাতিও কম নয়!

১৯৮৭-এর অ্যাশেজে টানা তিন টেস্টে সেঞ্চুরি করে রেকর্ড গড়েছিলেন ক্রিস। জ্যাক হবস ও ওয়ালি হ্যামন্ডের পর প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে অ্যাশেজে টানা তিন সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তিনি। মাইক গ্যাটিংয়ের অধীনে সেবার খুব ভালো সময় যাচ্ছিলো না ইংলিশদের। কিন্তু অ্যাশেজ সিরিজে ক্রিস ব্রডের ৭০ গড়ে ৪৬৭ রানে ইংলিশরা ২-১ এ সিরিজ নিজেদের করে নেয়!

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বরাবরই ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতেন ক্রিস। অ্যাশেজ জয়ের এক বছর বাদেই আবারো সিডনিতে টেস্টে মুখোমুখি হয় দুই দল। সেখানে ১৩৯ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন ক্রিস ব্রড। এমন ইনিংস খেলার পরেও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না! বোল্ড আউট হবার পর ব্যাট দিয়ে স্টাম্পে বাড়ি মেরে ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি!

অবশ্য এর কারণে জরিমানার মুখেও পড়তে হয় তাঁকে। অস্ট্রেলিয়াকে পেলেই ক্রিস ব্রডের চোখে মুখে একটা অন্যরকম আগ্রাসন দেখা যেতো। মনে হতো পুরোনো কোনো শত্রুকে কাছে পেয়ে প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পুরো ক্যারিয়ারে ৫৯ গড়ে রান করেছেন তিনি!

অল্প বয়সেই ‘ওস্টেমেলিটিস’ বা হাড় ক্ষয়ে ভুগছিলেন ক্রিস। ১৫ বছর বয়সে হাড় ক্ষয়! ক্যারিয়ার যেনো শুরু না হতেই শেষ। তবুও, ২১ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হয়েছিলেন ক্রিস। গ্লুচেষ্টারশায়ারের হয়েই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যাত্রার শুরু। অভিষেকেই দেখা পান ফিফটির। সেখান থেকে কিছু সময় পর পাড়ি জমান ন্যটিংহামশায়ারে। আর সেখান থেকেই জাতীয় দলে উঠে আসা!

আশির দশকে পেস অ্যাটাকে তখন ক্রিকেট দুনিয়া ত্রাশ করছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, কলিন ক্রফট, অ্যান্ডি রবার্টসের মতো বোলাররা ব্যাটারদের জন্য তখন ২২ গজের আতংক। সে সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষিক্ত হন ক্রিস ব্রড। শক্তিশালী ক্যারিবিয়ান পেস অ্যাটাকের বিপক্ষে অভিষেকেই করেন ফিফটি।

এরপর ইংল্যান্ডের হয়ে ২৫ টেস্ট ও ৩৪ ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। খুব লম্বা ক্যারিয়ার না হলেও দুই ফরম্যাটেই প্রায় ৪০ গড়ে রান করেছেন ক্রিস! দুই ফরম্যাটে প্রায় ৩ হাজার রান করেছেন, যার মধ্যে টেস্টে ৬ সেঞ্চুরি ও ৬ ফিফটি এবং ওয়ানডেতে ১ সেঞ্চুরি ও ১১ ফিফটির মালিক তিনি। এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ৩২ হাজারেরও বেশি রান করেছেন! যার মধ্যে দেড়শোর বেশি ফিফটি ও পঞ্চাশের বেশি সেঞ্চুরির হাঁকিয়েছেন তিনি!

ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট কলিন ব্যাটম্যান একবার বলেছিলেন, ‘নিজের সম্ভাবনাময়ী ক্যারিয়ার ধ্বংসের পেছনে ক্রিস নিজেই দায়ী। ক্রিজে নিজের রাগ, আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় ৩০ বছর বয়সেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়; যখন একজন ক্রিকেটার নিজের সেরা সময় পার করে।’

১৯৮৭ এর পরবর্তী সময়ে ইনজুরি আর বাজে ফর্মে ছিলেন ক্রিস। সেরা ছন্দে ফিরতে পারছিলেন না তিনি। তখন পাকিস্তান সফরে যায় ইংলিশরা। ইমরান খানদের বোলিংয়ের সামনে ক্রিস ছিলেন নড়বড়ে। ফর্মে ফেরার আভাসও পাওয়া যাচ্ছিলো না। যার কারণে ১৯৮৯ এর পর আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২২ গজে থিতু হতে পারেননি তিনি। তবে, ঘরোয়া ক্রিকেট চালিয়ে যান তিনি ১৯৯৪ পর্যন্ত। এরপর ব্যাক ইনজুরিতে অবসর নেন এই ইংলিশ ওপেনার।

২০০৯ সালের লাহোর অ্যাটাকের কথা মনে আছে কি? পাকিস্তানের লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের বাইরে শ্রীলঙ্কা দলের গাড়িবহরে সন্ত্রাসী হামলা হয়। যেখানে ৬ জন দেহরক্ষী সহ ২ জন স্টাফ মারা যায়। ওই সিরিজে ক্রিস ব্রড ছিলেন ম্যাচ রেফারি। ক্রিস ব্রডের গাড়িও ওই হামলার মুখে পড়ে। সেই হামলায় এক আম্পায়ারও আহত হন। আর ক্রিস ব্রড নিজের জীবন বাজি রেখে সেদিন সেই আম্পায়ারের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

ক্রিকেট থেকে বিদায়ের পরেও মাঠ ছাড়েননি তিনি। প্রথমে ধারাভাষ্যকার এরপর ম্যাচ অফিসিয়াল হিসেবে কাজ করেন! ২০০৩ সালে ম্যাচ রেফারি হিসেবে অভিষেক। আর এক বছর বাদেই যুক্ত হন আইসিসির এলিট প্যানেলের ম্যাচ রেফারি হিসেবে। এরপর গেলো ১৭ বছরে অসংখ্য ম্যাচে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি এই দায়িত্বে গড়েছেন ত্রিপল সেঞ্চুরিও! ২০১৮ সালে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে ম্যাচ রেফারি হিসেবে ‘৩০০ ম্যাচ’ দায়িত্ব পালন করেন তিনি!

খেলোয়াড়ি জীবনের আক্ষেপ তিনি ম্যাচ অফিসিয়াল হয়ে ভুলেছেন। কিংবা ভুলেছেন নিজেরই ছেলেকে দেখে। ছেলে স্টুয়ার্ট ব্রড যে ইংল্যান্ডের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পেসার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link