সর্বশেষ টেস্টে ইংল্যান্ড ভারতকে যতটা নাস্তানাবুদ করেছে, রঙিন পোশাকে নিজেরা ঠিক ততটাই বিধ্বস্ত হয়েছে। সফরকারীদের সামনে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজে পরাজয় মেনে নিয়েছে ইংলিশরা। বিশেষ করে ব্যাট হাতে রয়, বাটলাররা ছিলেন ম্লান। তবে ব্যর্থতার এই সিরিজে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলেছেন একজন ফাস্ট বোলার, তিনি ২৮ বছর বয়সী রিচ টপলি।
দীর্ঘ সময়ের বিরতি কাটিয়ে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে ফরম্যাটে ইংল্যান্ড দলে ফিরেছিলেন রিকি টপলি। ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ৪ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে দলের দ্বিতীয় সেরা বোলার ছিলেন তিনি।
পরের ম্যাচে একাদশে জায়গা পাননি, আর সেই ঝাঁঝ মিটিয়েছেন সিরিজের শেষ ম্যাচে। সেদিন ২২ রানে তিন উইকেট নিয়ে একাই ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় টপ অর্ডার। আর সেই সিরিজের স্বাগতিকদের একমাত্র জয়ের নায়কও ছিলেন এই পেসার।
নিজের সেরাটা অবশ্য পঞ্চাশ ওভারের ফরম্যাটের জন্য তুলে রেখেছিলেন রিকি টপলি। ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় সিরিজ জেতা না হলেও সব ম্যাচেই তিনি ছিলেন সেরা পারফর্মারদের একজন।
বিশেষ করে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ভারতকে ১৪৬ রানে গুটিয়ে দিতে রুদ্ররূপ ধারণ করেছিলেন টপলি। ৯.৫ ওভার হাত ঘুরিয়ে ছয়টা উইকেট আর তার সাথে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কার ঝুলিতে পুরে ছিলেন। তবে এই সাফল্যের মত পিছনের গল্পটা এত সুন্দর নয়।
ইনজুরির হানা বারবার রিচ টপলিকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। মাত্র ২১ বছর বয়সে অভিষেকের পর যখন সমৃদ্ধ এক ক্যারিয়ারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন টপলি তখনই ইনজুরি তাকে ঝাঁপিয়ে ধরে। ঠেলে দেয় অলিখিত অবসরের দিকে। এই অবস্থা থেকে তিনি আবার ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে জড়াবেন সেটাও ছিল দূরতম কল্পনা।
তিন বছর আগেও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট থেকে অবসরের ভাবনা মাথায় এসেছিল রিচ টপলির। কেননা পাঁচ বছরের মধ্যে চারটি ফ্র্যাকচার ইনজুরির কারনে শখের ক্রিকেট তখন তার জন্য যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শুধুমাত্র বোলিং করার জন্য প্রতিদিন ইনজেকশনের সাহায্যে হরমোন গ্রহণ করতে হতো। তাছাড়া প্রতি মাসে একবার করে লন্ডনে গিয়ে পিঠে চেতনানাশক ব্যবহার করতে হতো।
সবকিছু প্রস্তুত করার জন্য বোলিং করার আগে এক ঘণ্টা জিমে কাটাতে হতো রিচ টপলিকে। বাধ্য হয়েই পঁচিশ বছর বয়সে ব্যাট বলকে বিদায় জানাতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন তিনি। কিন্তু ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) সেসময় এগিয়ে আসে। নির্বাচকরা তাকে জানান যে তারা টপলিকে নিজেদের পরিকল্পনায় রেখেছে কেননা তাঁর বোলিংয়ের ভ্যারিয়েশন গুলো স্রষ্টা প্রদত্ত উপহার ছিল। ইসিবির আশ্বাস পেয়ে নিজের ভাবনাতে পরিবর্তন আনেন টপলি।
নিজেকে আবার ক্রিকেটে ফেরানোর আগে রিচ টপলি সাময়িক বিরতি নেন। সেসময় তিনি তাঁর চিন্তাধারাকে ক্রিকেট থেকে দূরে সরিয়ে বন্ধুদের সাথে সঙ্গীত জগতে চলে আসেন। তিনি শীঘ্রই পেকহামের একটি স্টুডিওতে নিজের ড্রামিং দক্ষতা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছিলেন এবং গিটার ব্যবহারের বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন।
এই ব্যাপারে টপলি বলেন, ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আমি এমন বন্ধু পেয়েছি যারা বিভিন্ন উপায়ে আমাকে সাহায্য করেছে। এছাড়া তাদের কাজগুলো আমাকে নতুন ভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল।’
কিন্তু সঙ্গীত জগতে আরো কিছু সময় কাটানোর আগেই পৃথিবীতে নেমে আসে করোনা মহামারি। স্টুডিও বন্ধ হয়ে যায়, টপলি নিজেও গৃহবন্দী হয়ে যান। কিন্তু তিনি একেবারে খালি হাতে বসে থাকেননি।
ক্যার্লিফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাইক্রো-ইকোনমিক্সে এক বছরের একটি কোর্সে ভর্তি হয়ে যান টপলি। এছাড়া নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট রাখতে ঘরের ভিতরেই ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা রেখেছিলেন তিনি।
সঙ্গীত, মাইক্রো-ইকোনমিক্সের কোর্স আর বন্ধুদের সঙ্গ এক নতুন জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় রিচ টপলিকে। এই সময়গুলো তাকে আর পরিপক্ক করে তোলে। একজন দার্শনিকের মতো ভাবতে এবং কথা বলতে শিখে যান তিনি। তিনি একটি লক্ষ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করার মূল্যও বুঝতে পেরেছিলেন।
রিচ টপলি উপলব্ধি করতে পারেন, একটা নির্দিষ্ট বল চার হতে পারে, ছয় হতে পারে। এমনকি পুরো একটি দিন নিজের নাও হতে পারে সেদিন হয়তো তাকে ভিলেন হতে হবে। কিন্তু এসব ব্যর্থতা মেনে নিতে হবে; মেনে নিয়েই নায়ক হওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মূলত ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার এই পুরোটা সময় মানসিক দৃঢ়তা আয়ত্ত করেছিলেন টপলি।
আর এই শক্তির জোরেই এত এত ইনজুরি চর বাধার পরেও রিচ টপলি তার বোলিংয়ের পুরোনো ধার ধরে রাখতে পেরেছেন৷ তিনি কখনই ভেঙ্গে পড়েননি।
রিচ টপলির ভান্ডারে আছে অনেক অস্ত্র৷ তিনি তীক্ষ্ণ বাউন্সের পাশাপাশি বাতাসের সাহায্যে বলকে সুইং করতে পারেন। আরও উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি বাম-হাতিদের থেকে বলকে বাইরের দিকে সুইং করেন। আর এটি তাকে একজন বিপজ্জনক বোলার করে তোলে। বলা হয়ে থাকে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানরা নাকি বাঁহাতি বোলারদের বিরুদ্ধে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু টপলির মতো মারাত্মক আউট-সুইঙ্গার থাকলে এমনটা কখনো মনে হবে না।
এসব কারনেই পূর্ণ ফিটনেস এবং ফর্ম ফিরে পাওয়ার পরপরই তাকে জাতীয় দলে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে ইংলিশ নির্বাচকরা। তাছাড়া ভারত ব্যতীত, প্রতিটি শীর্ষ দলে একজন করে বামহাতি বোলার রয়েছে—পাকিস্তানের শাহিন শাহ আফ্রিদি, অস্ট্রেলিয়া মিচেল স্টার্ক, নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মার্কো জ্যানসেন। কিন্তু ইংল্যান্ড দলে সেরকম কেউ না থাকায় টপলিকেও দেখা হচ্ছে বিশেষ দৃষ্টিতে।
রিচ টপলির যুদ্ধ এখনই শেষ হয়ে যায়নি। ভারতের বিপক্ষে ভাল করার পরই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। যে সম্ভাবনাময়ী ক্যারিয়ার থমকে গিয়েছিল ইনজুরির কারনে সেটির নবসূচনা হতে পারে টপলির ছয় উইকেটের স্পেলটি। তারপরও এখন পর্যন্ত যা করেছেন এই ইংরেজ, তাতেই মুগ্ধ হতে হবে যে কাউকে। বিস্মিত হয়ে বলতে হবে, এভাবেও কি ফিরে আসা যায়!