কোচদের ব্যাপারে আমাদের ক্রিকেট বোর্ড কোনোকালেই খুব সৌজন্যপরায়ন ছিলো না। যুগে যুগে কোচদের বাজে ভাবে বিদায় দেওয়াটা একটা সংষ্কৃতি হয়ে আছে বাংলাদেশের। কিন্তু ওটিস গিবসনের সাথে যেটা করা হলো, সেটা আসলে ইতিহাসকেই ছাড়িয়ে গেলো মনে হয়।
গিবসনকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আমাদের শুরুতেই একটা কথা মেনে নিতে হবে যে, তিনি বোলিং কোচ হিসেবে অসাধারণ; কিন্তু মানুষ হিসেবে সম্ভবত ততোটা ভালো নন। খেলোয়াড়দের তাকে নিয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে।
সেটা হতেই পারে। একজন কোচকে নিয়ে অভিযোগ থাকতেই পারে। এবং তাকে বোর্ড এই অভিযোগের ভিত্তিতে সরিয়ে দিতেই পারে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা এতোটা অশোভন হওয়া উচিত নয়।
প্রথমত আমরা দেখি যে, গিবসন কেমন কোচ?
প্রধাণ কোচ হিসেবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ছিলেন। সেখানে তার পারফরম্যান্স খুব খারাপ ছিলো, তা নয়। তবে তিনি আসলে নিজের ভালোটা দেখিয়েছিলেন দুই দফায় ইংল্যান্ডের বোলিং কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়।
সর্বশেষ এসেছিলেন বাংলাদেশে। এখানে পেস বোলিংয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার হাতে একটা নীরব বিপ্লব হয়েছে, এটা মানতেই হবে। তার হাত ধরেই এবাদত হোসেন, তাসকিন আহমেদরা শত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও টেস্টে বল করতে শিখেছেন। শরিফুল ইসলামের উন্নতির পেছনেও তার বিশেষ অবদান আছে। মুস্তাফিজুর রহমানের ইনসুইং নিয়ে তিনি খুব ভালো কাজ করেছেন। কাজ করেছেন খালেদ, রাহিদের নিয়েও।
বাংলাদেশে পেস বোলাররা ঘরোয়া বা আর্ন্তজাতিক খেলায় কোনো ধরণের পরিবেশ পক্ষে পান না। এই দেশ পেস বোলিং করার জন্য আদর্শ আবহাওয়া নয়। এরপর উইকেট বানানো হয় অত্যন্ত নিম্নমানের। সেখানে পেসাররা তেমন কিছু করতে পারেন না। ফলে নেট বোলিংই একমাত্র ভরসা হয়ে থাকে পেসারদের জন্য। আর সেইটুকু সম্বল নিয়ে এবাদত, তাসকিনরা যখন নিউজিল্যান্ডকে কাঁপিয়ে দেন, তখন বুঝতে হয়, গিবসন তার কাজটা সততার সাথেই করেছেন।
এবার আসুন খেলোয়াড়দের অভিযোগ সম্পর্কে।
গিবসনের বিপক্ষে খেলোয়াড়দের অভিযোগ হলো, দলের মধ্যে উপদল তৈরি করা এবং পরষ্পরের বিপক্ষে উসকে দেওয়া। এই অভিযোগ তার নামে বোলাররা কেবল নয়, সিনিয়র-জুনিয়র অনেকেই করেছেন। শোনা যায়, বোর্ডকে সরাসরি বেশ কয়েক জন খেলোয়াড় এটা জানিয়েছেন।
মজার ব্যাপার হলো, গিবসনের বিপক্ষে এই অভিযোগ নতুন নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি এরকম কিছু কাজ করেছিলেন বলে বাতাসে গুঞ্জন আছে। একজন কোচের এসব বৈশিষ্ট্য থাকা মোটেও ভালো কথা নয়। তিনি সেরা কোচ হলেও অবশ্যই দলের জন্য ক্ষতিকর।
এখন আমার কথা হলো,ইতিবাচক ও নেতিবাচক মেলাতে গিয়ে গিবসনকে ত্যাগ করাটাই সঠিক মনে হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ত্যাগ করারই পক্ষে। কিন্তু প্রক্রিয়াটা এমন হবে কেনো?
কেনো গিবসনকে বোর্ড থেকে সরাসরি কেউ জানিয়ে দেবেন না যে, তোমার সাথে আর চুক্তি বাড়াবো না? এটা তো খুব কঠিন কিছু নয়। গিবসন অভিযোগ করেছেন, তাকে এরকম কিছু বলা হয়নি। এমনকি তিনি বোর্ডকে যে মেইল করেছেন, তার উত্তরও পাননি। উল্টো বিসিবির পক্ষ থেকে বলটা গিবসনের কোর্টে পাঠিয়ে বলা হয়েছে, এই কোচই চুক্তি বাড়াতে চাননি।
গিবসনের কথা সত্যি হলে এই পর্বটা দুঃখজনক।
তবে এটা নতুন কিছু নয়। সেই গর্ডন গ্রিনিজকে বিশ্বকাপের মাঝপথে তাড়িয়ে দিয়েছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড। এরপর অনেক কোচকে আমরা অপমানিত করেছি। শেন জার্গেনসেনের সাথে খারাপ আচরণ করা হয়েছিলো বলে রটনা আছে। এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসে কোনো কোচ অবহেলার শিকার হয়েছেন, এমনও গুঞ্জন আছে। সর্বশেষ স্টিভ রোডসকে ইংল্যান্ড থেকে ডেকে এনে, তার সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ করে তাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে।
এই সংষ্কৃতির কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। এর ফলে আমরা দেশে হাই প্রোফাইল কোচ পাই না।
দেখুন আফগানিস্তান পর্যন্ত ফ্লাওয়ারের মানের কোচ জোগাড় করে ফেলে। আমরা পিটার মুরস, ফ্লাওয়ারদের প্রস্তাবই করতে পারি না; তারা বিবেচনায় নেন না। এই বিবেচনা করার অনেক কারণ আছে। বাংলাদেশে নাইট লাইফ পান না এসব বিদেশী কোচ, এখানে পরিবারের জন্য ভালো পরিবেশ পান না; অনেক কিছুই আছে। আর এর সাথে একটা ব্যাপার আছে যে, এখানকার বিদায়ী কোচদের বাজে অভিজ্ঞতা।
এই অভিজ্ঞতাটা এইসব কোচরা সব জায়গায় প্রকাশ করে দেন। ফলে নতুন করে আমরা বড় কোচদের পাই না। তারা যেচে এরকম ব্যবহার পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী করতে চান না।
দেশের সবকিছু আমরা রাতারাতি বদলাতে পারবো না। কিন্তু অতিথিপরায়ন বলে খ্যাত বাংলাদেশী হিসেবে একটু ভদ্রতাটা তো আমরা এখনই শুরু করতে পারি। তাহলে একটা ব্যাপারে তো এগিয়ে যাই আমরা।