একটা ভিডিও খুব ভাইরাল হল ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের পর। দুবাইয়ে ম্যাচ শুরুর আগে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। মজার ব্যাপার হল – শ্যাডো প্র্যাকটিসে যে শট গুলো খেলছিলেন, সেগুলো ম্যাচেও খেললেন। হ্যাঁ, মোহাম্মদ রিজওয়ান এমনই। তাঁর কাছে সাফল্যের প্রতিশব্দ হল পরিশ্রম। অধ্যাবসায় আর চেষ্টা থাকলে – কত অসম্ভবকেই না সম্ভব করা যায়। বিশ্বকাপের মঞ্চে যেন আবারো সেটা প্রমাণ করলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান।
তাই তো, বিরাট কোহলি-বাবর আজমকে ছাপিয়ে লাইমলাইটটা এখন অনেকটাই তাঁর ওপর। চলতি বছরে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি রান এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের। ১৫ ইনিংসে তাঁর রান ৮৩১। গড় ১০৩.৮৭ আর স্ট্রাইক রেট ১৪০.৩৭। গড় আর স্ট্রাইক রেটের মধ্যে অসম্ভব রকমের ভারসাম্য।
সব ধরণের টি-টোয়েন্টি মিলিয়েও সবার ওপরে থাকা নামটি হল রিজওয়ানের। সেখানে ৩৪ ইনিংসে তিনি ১৫৪১ রান করেছেন। গড় ৫৯.২৬; স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৮৮। এটুকু দিয়ে অন্তত বলা যায় – এই সময়ে টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের বিগেস্ট থিঙদের একজন মোহাম্মদ রিজওয়ান।
কিন্তু, রিজওয়ান তো এই ‘এলিট’-দের ভিড়ে রীতিমত একজন আউটসাইডার। বিশ্বক্রিকেটের কাঠামোতে তিনি বরাবরই অনেকের আড়ালে পড়ে থাকেন। আবার নিজের দেশেও তিনি থাকেন বাবর আজমের আড়ালে।
তবে, রিজওয়ানের ক্যারিয়ারের গতিবিধিটা এরকম। তিনি একে একে একাধিক দৈত্যতুল্য ব্যাটসম্যান বা ব্যক্তিত্বকে সরিয়ে নিজের জায়গাটা নিশ্চিত করেছেন দলে। ‘মধুর সমস্যা’ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, তাঁর পুরোটাই হয়তো একটা সময় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন মোহাম্মদ রিজওয়ান।
গত বছরের ইংল্যান্ড সফরেই তিনি টেস্ট সিরিজের সেরা খেলোয়াড় মনোনীত হয়েছিলেন। তবে এতে তিনি বেঞ্চে পাঠিয়েছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতা অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদকে!
এরপর গতবছরের নভেম্বের মাসেই তিনি টেস্ট দলের সহ-অধিনায়কও নির্বাচিত হন। তবে বাবর আজম খেলার থেকে ছিটকে যাওয়ায় নিউজিল্যান্ডের সাথে বক্সিং ডে টেস্টে তিনি অধিনায়ক হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবেন। মাত্র কয়েকটা টেস্টের অভিজ্ঞতাই রিজওয়ানের ঝুলিতে। আর তাতেই কিনা তিনি টস করতে নেমে যান। রিজওয়ানের চাইতে কম টেস্ট খেলে অধিনায়কত্ব করার নজির আছে আর শুধুমাত্র জাভেদ বুরকির; তা সে ঘটনা তো ১৯৬০ এর!
পাকিস্তান দলের ব্যাটন সামলানো সবসময়ই কঠিন কাজ। এখানে সমর্থক, মিডিয়া সবকিছুর চাপ আষ্টেপৃষ্ঠে থাকে। আর সেই কঠিন কাজটাই করে দেখাতে হবে রিজওয়ানকে। অবশ্য এর চাইতে কঠিন কাজটাও তিনি করেছেন, টি-টোয়েন্টি সিরিজে। টি-টোয়েন্টির সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজম না থাকায় তাঁর জায়গাটা পূরণ করার দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে, সেটা কে নিয়েছে? মোহাম্মদ রিজওয়ান!
সেখানেও কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না রিজওয়ানের জন্যে। প্রথম ইনিংসে রিজওয়ানের মধ্যে জড়তা দেখা গেছে যথেষ্টই। পাওয়ার প্লেতে হায়দার আলীকে সাথে নিয়ে ওপেনিং করতে নেমে তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে আউট হবার পর সরফরাজকে আবার ফেরানোর একটা দাবিও উঠেছিল। তবে সরফরাজ যেহেতু আগে কখনও ওপেনিং করেননি, সেই দাবি যৌক্তিকতা পায়নি।
রিজওয়ান আসলে খুবই ধৈর্য্যশীল।
দুটো বছর তিনি দলের আলোচনার বাইরে ছিলেন। কখনও দল ঘোষণায় ডাক পেয়েছেন তো কখনও পাননি। আর পাবেনই বা কিভাবে? সরফরাজ আহমেদ তো তখন খোদ অধিনায়ক, ফলে রিজওয়ান তখন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ‘সেকেন্ড চয়েস’ দলের জন্যে।
তবে রিজওয়ান কখনও আশা হারাননি। তিনি এগিয়ে গেছেন নিজের মত করেই। আর তার সুফল তো তিনি পাচ্ছেনই, পাচ্ছে পাকিস্তান ক্রিকেট দলও। মোহাম্মদ হাফিজকে সাথে নিয়ে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে রান চেজিংয়ের ম্যাচটাই দেখুন না! কি দারুণ ব্যাটিংটাই না করলেন তিনি।
তবে দলের সাবেক কোচকেও এ ব্যাপারে কিছুটা কৃতিত্ব দিতে হবে। রিজওয়ানের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর কাজটা তো কিছূটা হলেও তিনি করেছেন। আর তাতেই এমন পাকিস্তান দলের নির্ভরতা হতে পারছেন রিজওয়ান। সেই সাবেক কোচটি হলেন মিসবাহ উল হক।
তিনি ওই নিউজিল্যান্ড সফর চলাকালেই বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের অধিনায়ক ঘোষণা হওয়ার পর এমন ইনিংস প্রশংসার যোগ্য। আমরা জানি নিউজিল্যান্ডে খেলাটা কতটা কঠিন। এই বিরূপ পরিবেশে এমন খেলা রিজওয়ানকে আরো আত্মবিশ্বাসী করবে।’
তবে পাকিস্তানের জন্যে সেই নিউজিল্যান্ড সফরের কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না একদমই। সিরিজের আগে নিজেদের গোছানোর জন্যে মাত্র ৬ দিন সময় পেয়েছে সবাই। তা দলের বাকিদের পারফর্ম্যান্সের নাজুক অবস্থাতে সেই প্রস্তুতির ঘাটতি ভালভাবেই চোখে পড়েছে। আর তাতেই রিজওয়ান ছিলেন অনন্য।
এই কয়েক বছর আগেও দলের অংশ ছিলেন না রিজওয়ান। হয়তো ২০২০-২১ এ এসেও দলের অংশ হতে পারতেন না যদি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতেন। তবে রিজওয়ান তা করেননি। তিনি নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন, টি-টোয়েন্টি তে সেরাটাই খেলেছেন। এখন তো তিনি দলের স্তম্ভও!
মোহাম্মদ রিজওয়ানের ক্যারিয়ার গ্রাফটা খুবই স্পষ্ট। তিনি সামান্য থেকে বিরাট ব্যাটসম্যানে পরিণত করেছেন নিজেকে। রূপান্তরের অবিস্মরণীয় নজীর তিনি। ক্যারিয়ারের প্রথম ২৬ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিনি মাত্র ১৭.২৩ গড়ে করেছিলেন মাত্র ২২৪ রান। স্ট্রাইক রেট ছিল মোটে ৯৭.৮।
সেখান থেকে যেন আমূল বদলে ফেলেছেন নিজেকে। ৪৪ টি টি-টোয়েন্টি শেষে তাঁর প্রায় ১২০০ ছুঁইছুঁই রান, ৫০-এর ওপর গড়। নয়টি হাফ সেঞ্চুরির পাশে একটি সেঞ্চুরি – একালের ক্রিকেটে এর চেয়ে বড় রূপান্তর আর নেই।