ছেলেদের টেস্ট ক্রিকেটে ২০ জন খেলোয়াড় জীবনের প্রথম বলে উইকেট পেয়েছেন। বাকি ১৯ জনের মিলিত পরিসংখ্যান ২০০ টেস্টে ৫৯২ উইকেট। বাকি একজনের, তাঁর, ১০১ টেস্টে ৪০৩ উইকেট। ১৯৯৯ থেকে এখনো অবধি অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বিদেশি ফিঙ্গার স্পিনারের গড় ৫৩।
দেশীয়, অর্থাৎ অস্ট্রেলিয় ফিঙ্গার স্পিনারের গড় সামান্য ভদ্রস্থ – ৩৫। তাঁর গড় ৩২.৮৭। তিনি কে? নাথান লিঁও। বর্তমান যুগের অন্যতম সেরা স্পিনার। আজ থেকে বছর ১৫ আগে যেমন একটা তর্ক চলতো, বিশ্বসেরা স্পিনার কে? মুত্তিয়া মুরালিধরন আর শেন ওয়ার্নের মধ্যে। এখনও চলে। তর্কটা থেকে গিয়েছে।
শুধু কুশীলবরা বদলে গিয়েছেন। এখন তাঁদের নাম রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও লিঁও। মুরালি আর ওয়ার্নের ক্ষেত্রে ওয়ার্ন নৈতিকভাবে সামান্য এগিয়ে থাকতেন। কারণ মুরালির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে ধোঁয়াশা। লিঁও আর অশ্বিনের লড়াইতে সেই সমস্যা নেই। আরামসে অশ্বিন কিছুটা এগিয়ে। টেস্টে দুজনের মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়েছে ১৭ বার। অশ্বিন সেই ১৭ ম্যাচে ৮৩ উইকেট পেয়েছেন ৩২.৫০ গড়ে।
আর লিঁও ৬৬ উইকেট পেয়েছেন ৩৬.৩১ গড়ে। পরিসংখ্যানগত দিক দিয়েও অশ্বিন এগিয়ে। সামগ্রিক বিচারেও অশ্বিন এ যুগের শ্রেষ্ঠ স্পিনার। তাঁর বৈচিত্র বেশি। কিন্তু আজকের লেখার বিষয় টা দুজনের প্রতিদ্বন্দীতা বা অশ্বিন বন্দনা নয়। আজকের লেখাটা নাথান লায়ন কে তাঁর ৪০০ উইকেট পাওয়ার দিনে যোগ্য সম্মান দেবার জন্য।
২০০৭ সালে সিডনিতে ওয়ার্ন বিদায়ের পর অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন স্পিনার পরখ করে দেখেছে। বিভিন্ন রকমের স্পিনার। এমনকি ক্যামেরন হোয়াইট ২০০৮ এর ভারত সফরের প্রথম দুটি টেস্টে দলের প্রধান স্পিনার ছিলেন। সেই ক্যামেরন হোয়াইট, যাঁর রুজি রুটির বন্দোবস্ত করতো তাঁর ব্যাটের রান। বোলিং বলতে মাঝে মধ্যে ওই একটু হাত ঘোরানো। এরকম সময়ে নাথান লায়ন বলে এক যুবক, পিচ কিউরেটারের কাজ নিয়ে পৌঁছলেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া।
অত:পর দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া প্রশিক্ষক ড্যারেন বেরির নজরে আগমন এবং মাস সাতেকের প্রথম শ্রেণীর অভিজ্ঞতা নিয়ে দলের প্রধান স্পিনার হিসাবে শ্রীলংকা প্রেরন, এবং টেস্ট ক্রিকেটে নিজের প্রথম বলে সাঙ্গাকারা নামক এক সামান্য বিখ্যাত ব্যাটারের উইকেট প্রাপ্তি। এক্কেবারে ক্লাসিক অফস্পিনার উইকেট বলতে যা বোঝা যায়, উইকেট টা ছিল একেবারে তাই।
রাউন্ড দ্য উইকেট এসে আঙুলের জোর প্রয়োগ করে হাওয়ায় হালকা ভাসিয়ে দেয়া বল, সামান্য ডিপ, হালকা টার্ন এবং আউটসাইড এজ। বর্তমান যুগে ক্লাসিক অফস্পিনার প্রজাতি প্রায় লুপ্ত। লায়ন সেই প্রজাতির সবেধন নীলমনি হয়ে রয়ে গিয়েছেন। এমনকি অশ্বিন কেও ঠিক ক্লাসিক অফস্পিনার বলা যায় না। ক্লাসিক অফস্পিনার মানে কি? ডানহাতি ব্যাটারের অফস্টাম্পের বাইরে সমানে আক্রমণ করে যাওয়া।
মার খাবার ঝুঁকি নিয়েও উইকেট পাবার জন্যই বল করা। ডিপ ও লুপের ফায়দা তোলা। গতি ও ফ্লাইটের হের ফের ঘটিয়ে উইকেট নেওয়া। এর প্রত্যেকটি গুন্ নাথান লায়নের মধ্যে রয়েছে। অশ্বিন লায়নের মতো এতটা আক্রমণাত্মক নন। অনেক নিয়ন্ত্রিত। দু একটা চার খেলেই (বিশেষত বিদেশের মাঠে) কভার অঞ্চল আর খোলা রেখে ব্যাটারকে প্রলুব্ধ করেন না। অফের বাইরে বল না করে মিডিল লেগে করতে থাকেন।
এগুলো অবশ্য মোটেই অশ্বিনকে লায়নের চেয়ে কম প্রতিভাবান প্রতিপন্ন করার জন্য বলা নয়। অশ্বিন নিজের মতো। লিঁওও নিজের মত। একজন স্পিন বোলিংয়ের আলফ্রেড হিচকক তো অপরজন স্ট্যানলি কুব্রিক। দুজনেই শিল্পী। দুজনকে বোলিং করতে দেখাই একই রকম আরামদায়ক। শুধু প্রকৃতিগত ভাবে দুজনেই আলাদা, এই যা।
২০১৭ সালের মার্চে ব্যাঙ্গালুরুতে লিঁও’র ৫০ রানে ৮ উইকেট ভোলার নয়। বা ২০১৪ র এডিলেডে ভারতীয়দের হৃদয় বিদারক বোলিংও নয়। স্মিথের বিক্রম মাখা ২০১৯ এর এজবাস্টনে লায়নের ৯ উইকেট? সেটাও ভুলে গেলে চলবে কেমন করে ? বা হেডিংলিতে বেন স্টোকসকে আউট করেও আউট না করা এবং স্কুল ক্রিকেট সুলভ রান আউট না করতে পারা ? আসলে নাথান লায়নকেই ভোলা যায় না। তিনি রয়েছেন ভালোয় মন্দয়। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের সেবক হয়ে।
অস্ট্রেলিয়ানরা ম্যাচ ট্যাচ জেতার পর জোটবদ্ধ হয়ে একটি গান গায়। ‘আন্ডার দ্য সাউদার্ন ক্রস’। হাসি যদ্দিন ছিলেন, তিনিই কোরাসের প্রধান গলা ছিলেন। হাসি খেলা ছাড়ার পর সেই দায়িত্ব দিয়ে যান লিঁওকে। ৩৪ বছর হয়ে গেলো তাঁর। আর কদ্দিন থাকবেন কে জানে? তখন অন্য কেউ গাইবেন ‘আন্ডার দ্য সাউদার্ন ক্রস’। কিন্তু লিঁও থেকে যাবেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিঙ্গার স্পিন বোলার হয়ে।