স্বর্ণযুগের চার মহানায়ক: আইসিসির মূল্যায়ন

ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে ব্যাটসম্যান, বোলার এবং অলরাউন্ডারদের পয়েন্ট দিয়ে থাকে (০ থেকে ১০০০ স্কেলে) আর এরই ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্রিকেটারদের র‌্যাংকিং করা হয়। যে ফর্মুলার ভিত্তিতে এই পয়েন্ট দেওয়া হয়, সেটা খুব একটা স্পষ্ট নয় তবে প্রতিপক্ষের শক্তি, ম্যাচের পরিস্থিতি, উইকেটের ধরন ইত্যাদিও বিচারে আনা হয়।

আইসিসির পয়েন্ট অনুযায়ী অলরাউন্ডারদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়েছেন স্যার গ্যারি সোবার্স (৬৬৯ পয়েন্ট)। তারপরই আছেন ইয়ান বথাম ৬৪৫ পয়েন্ট পেয়ে। তুলনায় ইমরান খান, কপিল দেব এবং স্যার রিচার্ড হ্যাডলির সর্বোচ্চ পয়েন্ট যথাক্রমে ৫১৭, ৪৩২ এবং ৪৮৩। এর কারণ ইয়ান বোথামের ক্যারিয়ার খুঁটিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যাবে।

একই সিরিজে ২৫০ রান ও ২০ উইকেট বথাম নিয়েছেন ৩ বার, কপিল ২ বার, ইমরান ও হ্যাডলি একবারও নয়। একই টেস্টে এক ইনিংসে ৫০ রান ও ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব বোথামের ৭ বার, হ্যাডলির ৬, কপিলের ৪ এবং ইমরানের ২ বার। একই টেস্টে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড বোথাম এবং ইমরানের আছে একবার করে, কপিল বা হ্যাডলির এই কৃতিত্ব নেই।

সুতরাং এটা মোটামুটি পরিস্কার যে পিক ফর্মের বোথাম অন্য তিন  জনের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। সেই সময় তিনি বারবার একই ম্যাচে এবং সিরিজে ব্যাট এবং বল দুটোতেই সমান উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। আইসিসির অলরাউন্ডারদের র‌্যাংকিংয়েও বোথাম শীর্ষে ছিলেন টানা ৭ বছর – ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪।

ইমরান খান বথাম সহ অন্য তিন অলরাউন্ডারদের টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যান সামগ্রিক ক্যারিয়রের ব্যাটিং এবং বোলিং গড়ের বিচারে। ব্যাট হাতে ইনিংস প্রতি তার গড় রান প্রায় ৩৮, উইকেট পিছু তিনি রান দিয়েছেন ২৩। সুতরাং তার ব্যাটিং আর বোলিং গড়ের তফাৎ ১৫ রানের যা অন্য তিনজনের চেয়ে অনেকটাই বেশি (বথাম ও হ্যাডলির ক্ষেত্রে এই তফাৎ ৫, কপিলের ১)।

আইসিসির অলরাউন্ডারদের র‌্যাংকিয়ের শীর্ষে ইমরান ছিলেন ৮ বার, এখানেও তিনি অন্য তিনজনের চেয়ে এগিয়ে (হ্যাডলি ৫, কপিল ৩)। হ্যাডলির অবশ্য বেশি প্রাধান্য বল হাতে। ১৯৮৪ থেকে তার ক্যারিয়রের শেষ দিন অর্থাৎ ১৯৯০ অবধি তিনিই ছিলেন পৃথিবীর সর্বোত্তম বোলার – টানা ৭ বছর।

তাহলে কি দাঁড়াল? পিক ফর্মের বথাম চার জনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সামগ্রিক ক্যারিয়ার ধরলে ইমরান। আর রিচার্ড হ্যাডলি বোলারদের মধ্যে শুধু এই চারজনের মধ্যেই নয়, সর্বকালের নিরিখেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ।

আর আমাদের কপিলদেব? কপিলের দুর্ভাগ্য যে টেস্ট ক্রিকেটে তার ক্যারিয়ারের সেরা সময়ের সঙ্গে ইয়ান বথামের সেরা সময় ওভারল্যাপ করে গেছিল। এবং বথামের ক্যারিয়র গ্রাফ নামতে শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই তিনিও হাঁটুর চোটে ভুগতে আরম্ভ করেন। সেই সঙ্গে দারুণ ভাবে উঠে আসেন ইমরান ও হ্যাডলিও। তবু আইসিসির আরও একটি লিস্টে কপিল দেবের প্রাধান্য প্রশ্নাতীত – একদিনের সেরা ক্রিকেটারদের দিয়ে গড়া লিস্ট।

সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার তালিকায় এই চারজনের মধ্যেই শুধু নয়, সর্বকালের সর্বাধিক পয়েন্ট রয়েছে কপিলদেবের নামে (৬৫৩)। তুলনায় বোথামের সর্বাধিক পয়েন্ট ৪৬৮, ইমরানের ৪৮০ আর হ্যাডলির ৪৭০। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ – টানা ১২ বছর ধরে এক দিনের ক্রিকেটে এক নাম্বার অলরাউন্ডার ছিলেন কপিল। অন্যান্যদের কপালে এই শিরোপা জুটেছে মাত্র একবার করে।

চারজনের একদিনের ম্যাচে পরিসংখ্যান দেখলে অনেকের অবশ্য ভ্রু কুঁচকে যেতে পারে। কারণ একদিনের ম্যাচে ইমরানের ব্যাটিং গড় কপিলের চেয়ে প্রায় দশ রান বেশি, বোলিং গড় প্রায় সমান সমান। সে ক্ষেত্রে আইসিসি কপিলকে এগিয়ে রাখে কোন যুক্তিতে?

যুক্তি হচ্ছে ব্যাটিঙের ক্ষেত্রে স্ট্রাইক রেট আর বোলিঙের ক্ষেত্রে ইকনমি রেট। এই দুটোতেই কপিল ইমরানের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে – প্রতি একশো বলে ইমরানের রান ৭৩, কপিলের ৯৫। ওভার প্রতি কপিল গড়ে ৩.৭ রান দিয়েছেন, ইমরান ৩.৯। আর এটা নিশ্চই বোঝানোর প্রয়োজন নেই যে একদিনের ম্যাচে এই দুটো ফ্যাক্টর কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

এর সঙ্গে যদি ফিল্ডিং (বিশেষ করে আউটফিল্ডিং) আর রানিং বিটউইন দ্য উইকেটস যোগ করেন তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় যে এই চারজনের মধ্যে একমাত্র কপিলই আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারতেন অনায়াসেই।

একদিনের বা টেস্ট ক্রিকেটেও কপিলের কয়েকটি ঝোড়ো ইনিংস টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও উৎরে যেত অনায়াসে। অন্যরা তিনজনের মধ্যেও নি:সন্দেহে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সফল হওয়ার প্রতিভা যথেষ্ট পরিমানেই ছিল। কিন্তু তার জন্য তাদের নিজের ক্রিকেটে বেশ কিছুটা এডজাস্টমেন্ট করতে হত।

আই সি সির পয়েন্টের ভিত্তিতে কিছুদিন আগে উইজডেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একদিনের দল ঘোষণা করেছে। এই দলের ক্যাপ্টেন করা হয়েছে কপিলদেবকেই। দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন – ভিভ রিচার্ডস (সর্বকালের সর্বোচ্চ ব্যাটিং পয়েন্ট), ডিন জোন্স, ডেভিড গাওয়ার, গ্রেগ চ্যাপেল, জাহির আব্বাস, এবি ডি ভিলিয়ার্স (উইকেট কিপার), রিচার্ড হ্যাডলি, শন পোলক, জোয়েল গার্নার এবং মুত্তিয়া মুরালিধরন। যথেষ্ট শক্তিশালী দল। তবে এর বিপক্ষে আরও একটি দল নামানো যেতে পারে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link