জাতি হিসেবে ডাচরা খুব একটা বড় নয়, কিন্তু ফুটরলীয় প্রতিভায় ভরপুর তাঁরা। ফুটবল ইতিহাসের সেরা কিংবদন্তিদের একাংশের ঠিকানা এই নেদারল্যান্ডস। দুই পায়ের জাদুতে তাঁরা সবাই মোহিত করেছেন নিজেদের প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের। আর তাদের একজন ফ্র্যাঙ্কলিন এডমুন্ডো রাইকার্ড, নেদারল্যান্ডস ফুটবল ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশের ধারক।
ইয়োহান ক্রুইফের দর্শন, নব্বই দশকের সেই আয়াক্স স্কোয়াড, আধুনিক বার্সেলোনার গড়ে ওঠা – সবকিছুই আদোতে আলাদা। তবে এসব ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা এসে মিশেছে ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডের জীবনে। এই কিংবদন্তির শিরা-উপশিরায় মিশে আছে পরিপূর্ণ ফুটবল শৈলী।
১৯৬২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর নেদারল্যান্ডসের শহরে জন্মগ্রহণ করেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। বাবা হারমান রাইকার্ড ছিলেন পেশাদার ফুটবলার, বাবার দেখাদেখিই হয়তো ছোট্ট রাইকার্ডের মনে উঁকি মেরেছিল ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে মাত্র সতেরো বছর বয়সেই সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হন তিনি।
১৯৭৯ সালে আয়াক্সের হয়ে প্রথমবার পেশাদার ফুটবলে অভিষেক হয় ফ্রাঙ্ক রাইকার্ডের। অভিষেক ম্যাচে জয়সূচক গোল করে নিজের জাত চেনাতে ভুল হয়নি তাঁর। সবমিলিয়ে নিজের প্রথম মৌসুমে ২৩ ম্যাচ মাঠে নেমে চার গোল করেন এই ফুটবলার; সেই সাথে জিতে নেন লিগ শিরোপা।
১৯৮৮ সাল পর্যন্ত স্বদেশী ক্লাব আয়াক্সের হয়েই খেলেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ভূমিকায় নিজের দায়িত্ব ভালভাবেই পালন করেন তিনি। দলটির হয়ে তিনটি লিগ শিরোপা এবং একটি ইউরোপীয় কাপ সহ সম্ভাব্য সব কিছু অর্জন করেছেন এই মিডফিল্ডার। হয়তো আয়াক্সের হয়ে গল্পটা আরো বড় হতে পারতো, কিন্তু তখনই দৃশ্যপটে হাজির হন আয়াক্সের তৎকালীন কোচ ইয়োহান ক্রুইফ।
ইয়োহান ক্রুইফের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। সেসময় অনুশীলন থেকে ফিরে আসার পরে ক্রুইফের অধীনে না খেলার প্রতিজ্ঞা করেন রাইকার্ড। আর এরপরই যোগ দেন পর্তুগিজ ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনে। কিন্তু প্লেয়ার রেজিষ্ট্রেশনের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ায় দলটির হয়ে খেলা হয়নি তাঁর; বাধ্য হয়েই ক্লাব ম্যানেজম্যান্ট ডাচ ফুটবলারকে লোনে রিয়াল জারাগোজাতে পাঠায়।
রিয়াল জারাগোজাতে এক বছর কাটানোর পর ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডকে নিজেদের দলে ভেড়ায় এসি মিলান। ইতালির এই ক্লাবে এসে নিজেকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করেন এই ফুটবলার; পরিণত হন বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারে। আক্রমণাত্মক মানসিকতা এবং বল পায়ে দৃঢ়তা অন্যদের চেয়ে রাইকার্ডকে অনন্য করে তুলেছিল।
এসি মিলানের হয়ে দুইটি ইউরোপীয় কাপ জিতেছেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। এর মাঝে ১৯৯০ সালের ইউরোপীয় কাপের ফাইনালে রাইকার্ডের একমাত্র গোলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল এসি মিলান। এছাড়া দলটির হয়ে দুইবার সিরি এ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে পুনরায় নেদারল্যান্ডসে ফিরে আসেন এই মিডফিল্ডার।
দ্বিতীয় দফায় নিজের প্রিয় ক্লাব আয়াক্সে দুই বছর ছিলেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। এসময় আরো দুইটি লিগ শিরোপা এবং একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ নিজের অর্জনের ঝুলিতে যোগ করেন তিনি। শেষপর্যন্ত ১৯৯২/৯৩ মৌসুম শেষে অবসর গ্রহণ করেন নিজের সময়ের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। ক্লাব ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ৫৪৪ ম্যাচ খেলে ৯৭টি গোল এবং ৪৯টি অ্যাসিস্ট করেছেন রাইকার্ড।
অন্যদিকে জাতীয় দল নেদারল্যান্ডসের হয়ে ৭৩ ম্যাচ খেলা এই মিডফিল্ডার ১৯৮৮ এবং ১৯৯২ সালের ইউরো, ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন৷ এর মাঝে ১৯৮৮ সালের ইউরোতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ২-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ডাচরা। ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কাছে পরাজয়ের পরে পুরোপুরি বুটজোড়া তুলে রাখেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড।
তবে ফুটবলকে বিদায় বলতে পারেননি ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। তাই হয়তো ফিরে এসেছিলেন কোচ হয়ে; ফিরেছিলেন মাঠে। বার্সেলোনা, গ্যালাতাসেরে, স্পোর্টিং রটারডামের মত ক্লাবের পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস এবং সৌদি আরব জাতীয় দলের দায়িত্বে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। যদিও কাতালান শিবিরেই সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছেন তিনি।
নিজের পজিশনে সর্বকালের সেরাদের একজন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। তিনি তাঁর শারিরীক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বল দখলের লড়াইয়ে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারতেন। এছাড়া পজিশনিং সেন্স এবং ম্যাচ রিড করতে পারার অসামান্য ক্ষমতার জন্য প্রতিপক্ষের পাস আটকে দেয়া বেশ সহজই ছিল এই ফুটবলারের কাছে। খেলোয়াড় এবং কোচ দুই পরিচয়েই আগ্রাসনকে মূলমন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাইকার্ড।
ফুটবলার হিসেবে সর্বকালের সেরা ১০০ জনের মাঝেই আছেন ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড। উজ্জ্বলতম এক ক্যারিয়ার, কোচ হিসেবে প্রাথমিক সাফল্য আর এরপরই রহস্যজনক অন্তর্ধান – ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ড অনন্য এক চরিত্র হিসেবেই সমর্থকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর প্রতিভা আর পারফরম্যান্সের মুগ্ধতা ছড়িয়ে।