টওন্টনের ৩১৮, বাঁধ ভাঙা এক মহাকাব্য

২৬ মে, ১৯৯৯ সাল।

ইংল্যান্ডের অনষ্ঠিত আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ২১ তম ম্যাচ। টওন্টনে মুখোমুখি ভারত-শ্রীলঙ্কা। একদিকে ১৯৮৩ বিশ্বকাপের পর বিশ্বকাপ খরা কাটাতে আগ্রাসী ভারত অন্যদিকে, আগের বিশ্বকাপ জয়টা যে ফ্লুক ছিল নাহ সেটা প্রমাণে মরিয়া শ্রীলঙ্কা। আগের তিন ম্যাচে দুই দলই একটি করে ম্যাচ জিতেছে। পরের রাউন্ডে যেতে তাই জয়ের বিকল্প নেই দু’দলের কাছেই। টন্টনে ম্যাচটা ছিল তাই ডু অর ডাই ম্যাচ। জিতলে টিকে থাকবে বিশ্বকাপ স্বপ্ন অন্যথায় ধরতে হবে দেশে ফেরার বিমান।

এমতাবস্থায় টস জিতে টওন্টনের ভেজা পিচের সুবিধা নিতে বোলিং নিলেন লঙ্কান অধিপতি অর্জুনা রানাতুঙ্গা। শ্রীলঙ্কা দলে তখন চামিন্দা ভাস, মুত্তিয়া মুরালিধরণের মতো বোলার। ওপেনার হিসেবে ব্যাটিংয়ে নামলেন সদাগোপেন রমেশ আর সৌরভ গাঙ্গুলি। রানাতু্ঙ্গার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়েই যেন চামিন্দা ভাস প্রথম ওভারেই সাজঘরে ফেরত পাঠান রমেশকে।

ব্যাটিংয়ে আসেন রাহুল দ্রাবিড়। আগের দুই ম্যাচেই রান করতে ব্যর্থ গাঙ্গুলির ওপর তখন পাহাড়সম চাপ, অন্যদিকে বল হাতে আগুন ঝড়াচ্ছেন চামিন্দা ভাস। কিন্তু উইকেটটা যেন ভারতের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এল। ডানহাতি-বাঁ-হাতি কম্বিনেশনে দ্রাবিড়-গাঙ্গুলি দুজনেই খেললেন নিজেদের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস।

দ্রাবিড় শুরু থেকেই স্বভাববিরুদ্ধ আক্রমণাত্নক ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। উইকেটের চারপাশেই শট খেলছিলেন তিনি; তাঁর প্রতিটি ড্রাইভ, পুল কিংবা ফ্লিক করে মারা বাউন্ডারি মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল দর্শকদের চোখে। মাত্র ৪৩ বলে ফিফটিতে পৌঁছে যান দ্রাবিড়। গাঙ্গুলি ধীরস্থিরভাবে শুরু করেন, উইকেটের সাথে ধাতস্থ হতে সময় নেন কিছুক্ষণ। কিন্তু সেট হবার পর তিনিও হাত খুলে খেলতে শুরু করেন। 

বিশ ওভারের পূর্বেই শত রানের পার্টনারশিপ গড়েন দুজনে। প্রথমে সেঞ্চুরিতে পৌঁছান রাহুল দ্রাবিড়। ডি সিলভার বলে সিংগেল নিয়ে ১০২ বলে সেঞ্চুরিতে পৌঁছান তিনি। খুব বেশি দেরি করেননি গাঙ্গুলিও, দুই ওভার পরেই সেঞ্চুরি স্পর্শ করেন তিনি।

সেঞ্চুরির পর আরও বিধ্বংসী হয়ে যান দুইজনেই। মুরালিধরণ কিংবা ভাস কাউকেই রেহাই দিচ্ছিলেন নাহ। মুরালিধরনের এক ওভারে ১৮ রান নেন গাঙ্গুলি। পরের ওভারেই নেন ২১ রান। দ্রাবিড়ও কম যাচ্ছিলেন নাহ, চামিন্দা ভাসকে টানা তিনটি চার মারেন। 

অবশেষে ৪৬তম ওভারে মুরালির সরাসরি থ্রোতে রানআউট হন দ্রাবিড়। আউট হবার আগে ১৭টি চার আর একটি মাত্র চারের সুবাদে ১২৯ বলে ১৪৫ রান করেন তিনি। সমাপ্তি ঘটে ৩১৮ রানের মহাকাব্যিক এক জুটির। ১৭ টি চার এবং সাতটি ছয়ের সাহায্যে গাঙ্গুলি ১৫৮ বলে ক্যারিয়ার সেরা ১৮৩ রান করে একবারে শেষ ওভারে আউট হন। পরের ব্যাটসম্যানরা খুব বেশি রান না করতে পারলেও এই জুটির সুবাদে ভারত দাঁড় করায় ৩৭৩ রানের বিশাল সংগ্রহ।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে শ্রীলঙ্কা কখনোই ম্যাচ জয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারেনি। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে ৪২ ওভারে অলআউট হয়ে যায় ২১৬ রানেই। পাঁচ উইকেট নেন রবিন সিং আর ভারত ম্যাচ জেতে ১৫৭ রানে।

২০১৫ বিশ্বকাপে মারলন স্যামুয়েলস এবং ক্রিস গেইল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩৭২ রানের জুটি গড়ার আগে এই জুটিই ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের জুটি। সব মিলিয়ে এই ম্যাচ পরিচিত হয়ে আছে দ্রাবিড়-গাঙ্গুলির ম্যাচ হিসেবে। আর দুই কিংবদন্তির রেকর্ড আজও চূড়ায় থাকুক বা নাই থাকুক – সেই জুটিতে মোহাবিষ্ট হয়েই আছে ক্রিকেট বিশ্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link