২০০২ সালের ১৩ জুলাই। ইংল্যান্ড, ভারত আর শ্রীলংকার মধ্যে চলমান ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনাল ম্যাচ। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল ভারত আর ইংল্যান্ড। টসে জিতে সেদিন আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাগতিকরা। ৫ উইকেট হারিয়ে ৩২৫ রানের পাহাড় গড়ে অধিনায়কের আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক প্রমান করে ইংল্যান্ড। মার্কাস ট্রেসকোথিক এবং অধিনায়ক নাসের হুসেইনের ব্যাট থেকে সেদিন এসেছিল জোড়া সেঞ্চুরি।
৩২৫ রান, ২০২২ সালে এই রান একটু বেশি মনে হলেও আহামরি ভাববেন না হয়তো। কিন্তু যদি দুই দশক আগে ফিরে যান? যখন ৩০০ রানই দেখা যেতো কালেভদ্রে। ২০০২ সালের ক্রিকেট পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে আসলেই ৩২৫ রান সেদিন পাহাড়সম লক্ষ্য ছিল।
তার উপর রান তাড়া করতে নামা দলটি খেলছে বিদেশের মাটিতে। উপমহাদেশের একটি দলের জন্য ইংল্যান্ডের মাঠে ৩২৬ রানের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। বহুজাতিক টুর্নামেন্টে টানা নয় ফাইনাল হারা ভারতীয় ভক্তরা তখন হয়তো দশমবারের মত রানার আপ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল।
কিন্তু বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী – সফরকারী ভারতের ড্রেসিংরুম প্রস্তুতি নিয়েছিল মরণকামড় দেয়ার। উদ্বোধনী জুটিতে বীরেন্দর শেবাগের সাথে ১৪ ওভারে ১০৬ রানের জুটি করে সেটা বুঝিয়ে দেন ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। কিন্তু এরপর হঠাৎ ইংলিশদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে যায় ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ।
শেবাগ, গাঙ্গুলির পর টেন্ডুলকার সহ পাঁচ ব্যাটারকে চল্লিশ রানের মধ্যে হারায় ভারত। মিডল অর্ডারের ধ্বস নামলেও ক্রিজে ছিলেন তরুণ যুবরাজ সিং এবং মোহাম্মদ কাইফ। যুবরাজ ব্যাকফুটে নান্দনিক স্ট্রোক খেলতে থাকেন।
অন্যদিকে কাইফ তাঁর কব্জির জোরে মিড উইকেট অঞ্চলে রাজ করেছিলেন। সব মিলিয়ে এই জুটি ১৮ ওভারেরও কম বলে ১২১ রান যোগ করেছিল। এরপর শর্ট ফাইন লেগে সুইপ করতে গিয়ে আউট হয়ে যান যুবি।
আবারো শঙ্কা জেগেছিল এশিয়ান পরাশক্তিদের মনে। কিন্তু হরভজন সিং কাইফের সাথে মিলে দ্রুত ৪৭ রান যোগ করে ভারতকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। ৪৮তম ওভারে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ দুইটি উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফেরালেও তিন বল হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় ভারত। ইংলিশদের স্তব্ধ করে ২ উইকেটের নাটকীয় জয় পায় ভারত।
রান বন্যার এই ম্যাচে জয়ের নায়কদের ছাপিয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছিল ভারতীয় অধিনায়কের উদযাপন। লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক গাঙ্গুলি সেদিন করেছিলেন স্বভাববিরুদ্ধ এক উদযাপন। অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের উদযাপনের শোধ নিতেই গায়ের জার্সি খুলে উন্মত্তভাবে হাওয়ায় দুলিয়ে তার সেই বুনো উল্লাস প্রকাশ করেন।
লর্ডসের ব্যালকনি, সৌরভ গাঙ্গুলি আর একটা ভারতীয় জার্সি – ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালের কথা মনে করিয়ে দিতে এই কয়েকটি শব্দ যথেষ্ট।
এই ম্যাচটি শুধুমাত্র মাঠের খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ উজাড় করে দেয়ার ক্ষেত্র ছিল না – এটি ছিল স্মরণকালের সবচেয়ে রোমাঞ্চকরভাবে শেষ হওয়া ওয়ানডে ম্যাচগুলোর একটি। ৩২৬ রান তাড়ায় পাঁচ উইকেটে ১৪৬ – এরপরও ভারত জিতে নিয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে এর চেয়ে বেশি রান আগে কখনো করে নি তারা।
শুধু ভারতের ব্যাটিং ইনিংসেই নয়, উত্তেজনা ছড়িয়েছিল ইংল্যান্ড ব্যাটিং করার সময়ও। যখন নাসের হুসেইন তিনটি অঙ্কের ইনিংসের দেখা পেয়েছিলেন তখন তিনি প্রেস বক্সের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ উদযাপন করেছিলেন। ইংলিশ অধিনায়ক তিন আঙুল নিজের শার্টের পিছনে তিন নং এর দিকে ইশারা করেন।
নাসের হুসেইন পরে বলেছিলেন, ‘ব্যাটিং অর্ডারে তার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রেস বক্সে বসা কয়েকজন সাবেক ক্রিকেটার। তাদের জবাব দিতেই এমন উদযাপন।’
নাসের হুসেইনের খ্যাপাটে উদযাপন, সৌরভের উদ্দামতা আর যুবরাজ ও কাইফের তারুণ্যের সাহসিকতা সেদিন মোহিত করেছিল ক্রিকেট ভক্তদের। দুই দশক পরে এখনো আলোচনার খোরাক জোগায় সেই দ্বৈরথ। আরো অনেকটা সময় আড্ডার টেবিলে সেই রেশ থেকে যাবে নিশ্চয়।