১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। ‘At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom … ’
প্রায় দু’শো বছরের ব্রিটিশ অপশাসনের শাপমুক্তি ঘটিয়ে জন্ম নিল স্বাধীন ভারত। লেখা হলো ইতিহাস। ইতিহাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠলেন ‘জাতির জনক’-এর ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত ক্ষমতা দখলের লোভে অখন্ড ভারত বর্ষকে টুকরো টুকরো করার প্রস্তাবে সায় দেওয়া জওহরলাল নেহরু। আর, স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হওয়ার রেসিপি হিসেবে নবগঠিত দেশজুড়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হলো ‘অহিংসা’-কে।
‘অহিংসা’র পোস্টার বয়কে জাতির পিতা হিসেবে তুলে ধরে ভুলিয়ে দেওয়া শুরু হলো ক্ষুদিরাম বসু, বাঘা যতীন, বিনয় বাদল দীনেশ, মাস্টারদা সূর্য সেন, ভগৎ সিং – সহ কয়েক হাজার দেশমাতৃকার প্রতি নিবেদিত প্রানের আত্মবলিদানকে।
সর্বোপরি যার ডাকে সাড়া দিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ২৬,০০০ অকুতোভয় বীর সেনা আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে ইংরেজদের মেরুদণ্ডে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে ত্বরান্বিত ও সুনিশ্চিত করেছিলেন সেই দেশনায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু কে পর্যন্ত ব্রাত্য করে দেওয়া হলো।
স্বাধীন ভারতের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো যে স্বাধীনতা এসেছে অহিংসার বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে নয়। পাঠ্য বইতে ইংরেজদের গা সয়ে যাওয়া অহিংসা আন্দোলন ছাপতে যেখানে পাতার পর পাতা খরচ করা হলো, সেখানে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনকালে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের বাসিন্দা ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ইংরেজদের ভারত ছেড়ে যাওয়ার পিছনে যাকে দায়ী করেছিলেন সেই দেশ নায়ক নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ কে মাত্র কয়েকটা লাইনেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হলো।
কিন্তু, মনে রাখবেন – ‘এই দেশ যতটা গান্ধীর ঠিক ততটাই সুভাষের, হয়তো বা খানিকটা বেশিই।’
দুই এপ্রিল, ২০১১। ‘Dhoni finishes off in style. A magnificent strike into the crowd ! India lift the World Cup after 28 years !’
দীর্ঘ আঠাশ বছর পর আবারও বিশ্ব ক্রিকেটের সিংহাসনে আরোহণের মায়াবী রাত। ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকারের সুদীর্ঘ ও ক্রিকেট ইতিহাসে উজ্জ্বলতম ক্যারিয়ারের চরমতম অপ্রাপ্তির পরমতম পূর্ণতা প্রাপ্তির ঐশ্বরিক মুহূর্ত। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবার দেশের মাটিতে কোনো ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের বিশ্বজয়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, হিন্দু থেকে মুসলিম, জাতি – ধর্ম – বর্ণ – ভাষার বৈচিত্র্যময়তার কোলাজের মিলেমিশে তেরঙ্গা ক্যানভাস হয়ে ওঠা দেশের জাতীয় ধর্মের বিশ্বমঞ্চে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু, লাস্ট হার্ডলটাই অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছিল। আর অনিশ্চয়তার, আশঙ্কার ঝড়ের মাঝে তীরে এসে তরী ডোবার ভয়ের কালো মেঘ দেখে না ডরে দিল্লিবাসী যে ছেলেটা উত্তাল সমুদ্রে স্রোতের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নাও ভাসিয়ে পরম গন্তব্যের দিকে নাওটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল এবং অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশ আসা পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে ঢেউয়ের ছোবল বুক পেতে নেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাঘাতও করলো সেই ছেলেটি ধীরে ধীরে অজ্ঞাত কারণে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এই দুর্ভাগা দেশের পেড মিডিয়ার প্রচারের আলোর বৃত্ত থেকে ব্রাত্য হতে শুরু করলো।
ঠিক যেমনভাবে অহিংসার মোড়কে স্বাধীনতার প্রকৃত সেনাদের আত্মবলিদানকে ঢাকা হয়েছিল ঠিক একইভাবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ব্র্যান্ডভ্যালুর আড়ালে সর্বদা বিপদে রুখে দাঁড়ানো এক নির্ভীক যোদ্ধার অবদানকে লুকিয়ে ফেলার অসাধু প্রয়াস দেখা গেল, আজও দেখা যায়।
কিন্তু, মনে রাখবেন – ওয়াংখেড়ের ওই ঐতিহাসিক জয়ে যতটা মহেন্দ্র সিং ধোনির অবদান, ঠিক ততটাই অবদান গম্ভীরের, হয়তো বা খানিকটা বেশিই।
দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসু সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর সাথে কোনো ব্যক্তির তুলনা করা হয়নি। স্বাধিকার সংগ্রামের সাথে ক্রিকেটও মেলানো যায় না। শুধুমাত্র ইতিহাসে লিপিবদ্ধ দুটো ঐতিহাসিক ঘটনা ও পরিণতির মধ্যে সাদৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। দু’টোই তো বিজয়ই – ক্ষেত্রটা কেবল ভিন্ন।