একুশ শতাব্দীর শুরুর সময়, আর্সেনালের একাডেমি থেকে অযোগ্য ভেবে বের করে দেয়া হয় আট বছরের এক ইংলিশ শিশুকে। এরপর কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়, গানার্সদের থেকে প্রত্যাখান উপহার পাওয়া শিশুটা এখন অনেক বড় হয়েছে, ভুল প্রমাণ করেছে আর্সেনালের সিদ্ধান্তকে।
স্বয়ং আর্সেনালের কিংবদন্তি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার নিজে ২০১৫ সালে স্বীকার করেন সেদিনের সেই আট বছরের ছেলেটিকে ছেড়ে দেয়া ক্লাবের ইতিহাসের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
কেননা সেই ছেলে এখন রবার্ট লেওয়ানডস্কি, করিম বেনজেমাদের মতই বিশ্বের সেরা নাম্বার নাইনদের মধ্যে একজন। সে আজ ইংল্যান্ডের ইতিহাসের-ই সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা; হ্যাঁ ঠিক বুঝে ফেলেছেন, যার কথা বলা হচ্ছে তিনি হ্যারি এডওয়ার্ড কেন, টটেনহ্যাম এবং ইংল্যান্ডের বর্তমান অধিনায়ক।
১৯৯৩ সালের ২৮ জুলাই ইংল্যান্ডের ওয়ালহ্যামস্টো শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হ্যারি কেন। বেড়ে উঠেছিলেন চিংফোর্ডে। বাবা প্যাট কেনকে কোচ বানিয়েই শুরু হয়েছিল হ্যারি কেনের ফুটবল প্রশিক্ষণ। এরপর নিজের প্রিয় ক্লাব আর্সেনালের একাডেমিতে যোগ দেন তিনি, কিন্তু সেই গল্পে ঘটে করুণ সমাপ্তি।
আর্সেনাল থেকে ফিরে আসার পর ওয়াটফোর্ডের চোখে পড়ে কিশোর হ্যারির প্রতিভা। তাদের একাডেমিতে স্থান হয় তাঁর। অত:পর সেখান থেকেই কেনের গন্তব্য হয় টটেনহ্যাম হটস্পার। কয়েকটি লোন স্পেল বাদ দিলে ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় স্পার্সের জার্সি গায়ে কাটিয়েছেন তিনি।
২০০৪ সালে টটেনহ্যাম হটস্পারের অনূর্ধ্ব-১৮ দলে ছিলেন হ্যারি কেন। পাঁচ বছর যুব দলে থাকার পর ২০০৯ সালে মূল স্কোয়াডে জায়গা পান তিনি। তবে অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো কিছু সময়, শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে ইউরোপা লিগের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে মাঠে নামেন হ্যারি কেন।
অভিষেকের পর থেকে এক যুগ পেরিয়ে গিয়েছে। তরুণ হ্যারি কেন এখন অভিজ্ঞ আর পরিপক্ব। এই দীর্ঘ যাত্রায় স্পার্সদের হয়ে মোট ৪৩৫টি ম্যাচ খেলেছেন কেন। গোল করেছেন ২৮০টি, আর করিয়েছেন আরো ৬৪টি। কোরিয়ান তারকা হিউং মিন সনের সঙ্গে জুটি গড়ে প্রিমিয়ার লিগের ডিফেন্ডারদের ত্রাস হয়ে উঠেছেন তিনি।
এছাড়া ধারে থাকার সময় লেস্টার সিটি, মিলওয়াল এফসি এর মত দলেও খেলেছেন। সবমিলিয়ে ক্লাব ক্যারিয়ারে ৫১৪টি ম্যাচ খেলা হ্যারি কেন জালের দেখা পেয়েছেন ৩০৭বার। এবং অ্যাসিস্ট করেছেন ৮০টি।
২০১০ সাল থেকেই জাতীয় দলের আশেপাশে ছিলেন হ্যারি কেন। অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-২০ এর বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলার পর ২০১৫ সালে জাতীয় দলে ডাক পড়ে এই স্ট্রাইকারের। এরপর থেকে ইংলিশদের আক্রমণভাগের বড় দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই আছে।
এখন পর্যন্ত ৮৪ ম্যাচে ৫৮ গোল করা হ্যারি কেন ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোল দাতা। এছাড়া সতীর্থদের গোলে অবদান রেখেছেন ১৮ বার। বিশ্বকাপের মত মঞ্চে ১১ ম্যাচ খেলেই আট গোল আর চার এসিস্ট করেছেন তিনি। এই ইংলিশ তারকা যে বড় ম্যাচের খেলোয়াড় সেটাই প্রমাণ করে তাঁর বিশ্বকাপ পরিসংখ্যান।
ক্যারিয়ার জুড়ে ভুরি ভুরি গোল, মনে হতেই পারে হ্যারি কেনের ট্রফি ক্যাবিনেটও বোধহয় পরিপূর্ণ। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসেই দলীয় অর্জনে হ্যারি কেনের ঝুলি বড্ড শূন্য। অথচ প্রিমিয়ার লিগে তিনবার গোল্ডেন বুট জিতেছেন তিনি, ২০১৮ বিশ্বকাপেও জিতেছেন সোনালী জুতা; কিন্তু শিরোপা জিততে পারেননি কখনো।
হ্যারি কেন তাঁর সবটা দিয়েও পারেননি একবার শিরোপা মঞ্চে উঠতে। দায়টা দলের অন্যদের, নাকি কেনের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সও যথেষ্ট নয় – সেই উত্তর এখনো অজানা।
কিছু ফুটবলার জন্ম নেয় গ্রেট হওয়ার জন্যই। ক্যারিয়ারের প্রতিটি সময় ভাগ্যদেবীর আশীর্বাদ তাদের সাথে থাকে। হয়তো হ্যারি কেন তাদের মত নন, তাই গত এক দশক ধরে লড়াই করেও গ্রেটনেস পাওয়া হয়নি তাঁর। শিরোপা না জেতা নি:সঙ্গ এক শেরপাকে কে-ই বা দিতে চাইবে কিংবদন্তির মর্যাদা?
হ্যারি কেনের বয়সটা এখন ২৯, সামনে এখনো অনেকটা পথ বাকি। কি জানি, নিজের শিরোপা খরা কাটাতে পারবেন কি না এই স্ট্রাইকার। শিরোপা জিততে পারলে তো ভালো, না পারলে অবশ্য ট্র্যাজিক হিরো হিসেবেই ফুটবল-বিধাতা মনে রাখবে তার দুর্ভাগা সন্তানকে।