গ্রায়েম স্মিথ ছিলেন ২০০০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের অন্যতম উদীয়মান তারকা। সেবারের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল যুবরাজ সিং, মোহাম্মদ কাইফদের ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকা হয়েছিল প্লেট চ্যাম্পিয়ন!
প্লেট ফাইনালে বাংলাদেশকে হারানোর ম্যাচে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন গ্রায়েম স্মিথ (৫১)। মজার ব্যাপার হল, সেই ম্যাচে প্রোটিয়াদের জার্সি গায়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক জোনাথন ট্রট (৪১) পরবর্তীতে খেলেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে অবিসংবাদিত ‘সেরা অধিনায়ক’ স্মিথ কিন্তু তখন অধিনায়ক ছিলেন না। প্রোটিয়া যুব দলকে সেবার নেতৃত্বে দিয়েছিলেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান থামি সোলেকাইল।
প্রথম ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক মাত্র ১৮ বছর বয়সে। অভিষেকেই নিজের জাত চেনানো স্মিথ খেলেছিলেন ১৮৭ রানের এক ‘ম্যাচ উইনিং’ ইনিংস।
২০০২ সালের ৮ মার্চ, কেপটাউনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর স্মরণীয় টেস্ট অভিষেক। দলে নিয়মিত ওপেনার হিসেবে হার্শেল গিবস ও গ্যারি কার্স্টেন থাকায় পছন্দের পজিশন ছেড়ে স্মিথকে নামতে হয়েছিল ৩ নম্বরে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৮ রানের লড়াকু এক ইনিংস খেলেও দলের হার এড়াতে পারেননি তিনি।
২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে মাত্র ২২ বছর ৮২ দিন বয়সে সাউথ আফ্রিকার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে অভিষিক্ত হন স্মিথ।
দলে শন পোলক, জ্যাক ক্যালিস, মার্ক বাউচার, হার্শেল গিবসের মত সিনিয়র ক্রিকেটার থাকা সত্ত্বেও স্মিথের মত অনভিজ্ঞ তরুণ একজনকে ক্যাপ্টেন্সির গুরুদায়িত্ব দেয়া নিয়ে সে সময় বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল প্রোটিয়া ক্রিকেট বোর্ডকে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী টেস্ট ইতিহাসের সফলতম অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ। ২০০৩-২০১৪ সাল পর্যন্ত মোট ১০৯টি টেস্টে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। যা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
অধিনায়ক হিসেবে খেলা ১০৯ টি ম্যাচের মধ্যে স্মিথ জয় পেয়েছেন ৫৩টি ম্যাচে। এটাও টেস্ট ইতিহাসে ক্যাপ্টেন হিসেবে সর্বোচ্চ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড।
অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে কেবল সর্বোচ্চ ম্যাচ কিংবা সর্বোচ্চ জয়ই নয়, সর্বোচ্চ রানের মালিকও সাবেক এই বাঁ-হাতি লিজেন্ড (৮৬৫৯ রান)।
২০০৩ সালের জুনে অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন ২২ বছরের তরুণ গ্রায়েম স্মিথ। ব্যাট হাতে তাঁর ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের সুবাদেই ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজটা সেবার ২-২ ব্যবধানে ড্র করতে পেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
টানা দুই টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরিসহ (এজবাস্টনে ২৭৭ ও লর্ডসে ২৫৯) ৭৯.৩৩ গড়ে ৭১৪ রান করে সিরিজ সেরা হয়েছিলেন স্মিথ যা এক সিরিজে যেকোন সাউথ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানের জন্য সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।
ওই সিরিজেই দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে ‘দ্রুততম’ ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ১ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন স্মিথ। ১০০০ টেস্ট রান করতে স্মিথের লেগেছিল মাত্র ১৭ ইনিংস!
২০০৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ‘প্রথম’ দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন স্মিথ।
- পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে ১৪৮
- বার্বাডোজের কেনসিংটন ওভালে ১০৪
- অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে ১২৬
২০০৬ সালে জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৪৩৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ঐতিহাসিক সেই রান চেজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গ্রায়েম স্মিথ। খেলেছিলেন ৫৫ বলে ৯০ রানের ‘অধিনায়কোচিত’ এক ইনিংস। হার্শেল গিবসকে (১১০ বলে ১৭৫) সাথে নিয়ে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে যোগ করেছিলেন ১৮৭ রান।
২০০৭ সালে একটি ওয়ানডে ম্যাচে পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার রানা নাভেদ-উল-হাসানের এক ওভার থেকে ২৭ রান নিয়েছিলেন স্মিথ। ওই ওভারেই ওয়ানডে ইতিহাসের ‘প্রথম’ ব্যাটসম্যান হিসেবে এক ওভারে টানা ছয়টি বাউন্ডারি মারার কীর্তি গড়েন তিনি।
২০০৭ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের পূর্বে স্মিথের অধিনায়কত্বেই প্রথম বারের মত ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০০৭ বিশ্বকাপের প্রথম চার ম্যাচে টানা ৪টি ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন স্মিথ যা একজন অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপের একটি রেকর্ড।
২০০৮ সালে স্মিথের নেতৃত্বেই ৪৩ বছর পর প্রথম বারের মত ইংল্যান্ডের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২-১ ব্যবধানে জেতা ঐতিহাসিক সেই সিরিজে স্মিথের ব্যাট থেকে এসেছিল ৬১.৫০ গড়ে ৩৬৯ রান।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে পার্থ টেস্টের শেষ দিনে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ৪১৪ রানের টার্গেট ৬ উইকেট হাতে রেখেই সফলভাবে অতিক্রম করতে সক্ষম হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ওপেনিংয়ে নেমে ১০৮ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে ‘টেস্ট র্যাংকিংয়ের এক নম্বর দল’ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অবিশ্বাস্য সেই জয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন ‘ক্যাপ্টেন স্মিথ’।
২০০৮ সালের সেই সিরিজেরই তৃতীয় ম্যাচের ঘটনা। প্রথম ২ ম্যাচ জিতে সিরিজ জয়টা আগেভাগেই নিশ্চিত করে ফেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সিডনিতে শেষ টেস্টটা ছিল তাই কেবলই আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার। ১৬ বছরের মধ্যে ওটাই ছিল দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সিরিজ হার আর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রোটিয়াদের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়।
সিডনি টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত ৩০ রানের মাথায় মিচেল জনসনের হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা একটি ডেলিভারিতে বাঁ-হাতের কনুইতে মারাত্মক আঘাত পান স্মিথ। পুরো হাতটা ঢেকে ফেলা হয় প্লাস্টারে।
চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য প্রোটিয়াদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়িয়েছিল ৩৭৬ রান। সঙ্গত কারণেই একজন ব্যাটসম্যান কম নিয়ে বিশাল টার্গেট তাড়া করার দুঃসাহস তারা দেখায়নি।
দলীয় ২৫৭ রানের মাথায় যখন নবম উইকেটের পতন ঘটে, দিনের খেলা বাকি তখনও ৮.২ ওভার। অনেকে হয়ত ধরেই নিয়েছিল খেলা শেষ। কিন্তু না, সবাইকে হতবাক করে দিয়ে প্লাস্টার খুলে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাটিংয়ে নামলেন স্মিথ। ওই ভাঙা হাত নিয়েই স্মিথ খেললেন ১৭টা বল! প্রতিটা বল খেলতে গিয়ে স্মিথের ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিল সেদিন কতটা দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে!
দিনের খেলা শেষ হতে মাত্র ১০ বল বাকি থাকতে জনসনের বলে বোল্ড হয়ে যান স্মিথ। ম্যাচ না জিতলেও স্মিথ সেদিন জয় করেছিলেন লাখো কোটি দর্শকের হৃদয়।
ব্যাটিংয়ে বিশেষ করে অন সাইডে স্মিথ ছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের স্ট্রং। তাঁর ফেভারিট শট ছিল ফ্লিক। স্মিথের ব্যাটিংয়ে সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটা ছিল বাঁ-হাতি পেসারদের বিপক্ষে ‘অ্যাক্রস দ্য লাইনে’ খেলার প্রবণতা। অন সাইডে রান বের করতে গিয়েই এমনটা করতেন তিনি। মিচেল জনসন, জহির খান, নাথান ব্র্যাকেন, পেদ্রো কলিন্সদের বলে ক্যারিয়ার জুড়ে অসংখ্যবার ভুগতে হয়েছে তাঁকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ১৪ বার তিনি আউট হয়েছেন ভারতীয় বাঁ-হাতি পেসার জহির খানের বলে।
অধিনায়ক হিসেবে টেস্ট জয়ে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক গ্রায়েম স্মিথ। দল জিতেছে, স্মিথ অধিনায়ক, এমন ম্যাচে ১৫টি সেঞ্চুরি রয়েছে তাঁর। স্মিথ টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন এমন একটা ম্যাচেও হারেনি তাঁর দল দক্ষিণ আফ্রিকা। স্মিথের টেস্ট ক্যারিয়ারে পাওয়া ২৭টি সেঞ্চুরির প্রত্যেকটিতেই ‘অপরাজিত’ ছিল প্রোটিয়ারা যা একটি বিশ্বরেকর্ড।
ফিল্ডার হিসেবে টেস্ট জয়ে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ ধরার রেকর্ডটিও গ্রায়েম স্মিথের। দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে এমন ম্যাচে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৮২টি ক্যাচ নিয়েছেন স্মিথ।
গ্রায়েম স্মিথকে বলা হয় ‘ফোর্থ ইনিংস জিনিয়াস’। বেশিরভাগ ব্যাটসম্যানই যেখানে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, স্মিথ সেখানে ব্যতিক্রম। তাঁর ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি ইনিংস তিনি খেলেছেন চতুর্থ ইনিংসে।
টেস্ট ম্যাচের ৪র্থ ইনিংসে ৫১.৯৭ গড়ে স্মিথের সংগ্রহ ১৬১১ রান। আছে চারটা সেঞ্চুরি আর নয়টা হাফ সেঞ্চুরি। দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে কেবল এমন ম্যাচগুলো হিসেব করলে গড়টা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮৮ তে!
২০১৩ সালে ২৪ অক্টোবর, ক্যারিয়ারের ১১২ তম ম্যাচে দ্বিতীয় দক্ষিণ আফ্রিকান ও টেস্ট ইতিহাসের ১২তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৯০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন স্মিথ।
টেস্ট ক্রিকেটে এককভাবে সর্বোচ্চ চারটি ৩০০+ রানের ওপেনিং জুটির অংশীদার হলেন গ্রায়েম স্মিথ। হার্শেল গিবসের সাথে তিনটি এবং নিল ম্যাকেঞ্জির সাথে একটি।
- ২০০৩ সালে কেপটাউনে পাকিস্তানের বিপক্ষে গিবস-স্মিথ: ৩৬৮ রান
- ২০০৩ সালে বার্মিংহামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গিবস-স্মিথ: ৩৩৮ রান
- ২০০৪ সালে সেঞ্চুরিয়নে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গিবস-স্মিথ: ৩০১ রান
- ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে স্মিথ-ম্যাকেঞ্জি: ৪১৫ রান