হার্শা ভোগলের বয়স কত? আশির দশকের মাঝামাঝি যখন তিনি হায়দ্রাবাদ রেডিওয় টেস্ট কভার করতে যাচ্ছেন, তখন বর্ষীয়ান সহধারাভাষ্যকার, ড্রিঙ্কসের দুমিনিট তাঁর উপর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন সিগারেটে সুখটান দিতে। আর হার্শা হাসিমুখে কোঁকড়ানো পাতলা চুলের বিন্যাস নিয়ে সেই দুমিনিট প্রাণপণে এয়ারটাইম ভরিয়ে রাখছেন তাঁর উইট আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দিয়ে।
সেই সিরিজ, হায়দ্রাবাদের এক শিল্পী পাশের রাজ্যের কিংবদন্তীর জায়গায় সবুজ গালিচায় ছবি এঁকে তিনটে শতরান করে বিশ্ব দরবারে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন আর হার্শা ভোগলে তাঁর সামান্য বাকপটুতা আর অসামান্য ক্রিকেট প্রেম নিয়ে আইআইএমের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়ছেন এক অজানা সমুদ্রে।
আমরা এসব কিছু জানি না। জানি শুধু যখন আইআইএম আহমেদাবাদে তাঁকে বক্তৃতা দিতে ডাকা হয়, তখন একই উচ্ছ্বাসে বলে উঠতে পারেন যে ছেলেবেলা থেকেই এটা শিখে এসেছেন যে ভালোকে মনে রাখো এবং খারাপকে ভুলে যাও। ছেলেবেলা। হায়দ্রাবাদের বেগমপেটের দুই অধ্যাপকের সন্তান হর্ষ বিটেক ডিগ্রি এবং আইআইএমের এমবিএ সম ডিপ্লোমা নিয়েও এক এমন এক রাস্তায় পা রাখছেন, যেখানে কেউ আগে কখনও কংক্রিট, পিচ দূরের কথা নুড়ি পাথরও বিছায়নি। আশির দশক, ভারত তখন সবে রবি চতুর্বেদী, অনন্ত শেতলবাড়, কিশোর ভিমানি, নরোত্তম পুরি, সুশীল দোশিদের হাত ধরে রেডিও থেকে টিভির ধারাভাষ্যে আসছে। আসলে টিভিতে অত কথা বলতে নেই, কিন্তু কথা বলতে হয়, যাতে দর্শকরা আগ্রহী থাকেন।
অবশ্য আমাদের ছোটবেলা শুরু হয়েছে ইডেন টেস্ট আর হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে ভেসে আসা অমর অজর অজয় বোস কমল ভট্টাচার্য এবং পুষ্পেন সরকার দিয়ে। তাঁরা ক্লাব হাউস প্রান্তের প্রেসবক্সের সামনে যতটা স্বচ্ছন্দ, ততটাই গ্যালারি থেকে র্যামপার্টের দিকে তাকাতে। কিন্তু এঁদের সঙ্গে তো বড় হইনি। এঁরা লেজেন্ড, আমার শৈশবের কিংবদন্তি, বালু আলগানন, নরোত্তম পুরি, কিশোর ভিমানি, সূর্য প্রকাশ চতুর্বেদী, প্রেমাংশু চ্যাটার্জী, বিজয় মেহরা।
এঁদের কথা শুনে বা এঁদের শুনে বড় হচ্ছি। হর্ষ আমাদের বড় হওয়া, আমাদের ক্রিকেটের সঙ্গে বড় হওয়াকে ভাষা দিয়েছেন। তিনি স্বাচ্ছন্দে বলে দিয়েছেন, ‘ভারতীয় উইকেটের পতনে দর্শকদের উচ্ছ্বাসের একটাই অর্থ, শচীন টেন্ডুলকারের ক্রিজে আসা।’ শচীন আর ধোনির একসঙ্গে ব্যাটিং নিয়ে মন্তব্য করেছেন, একাধারে এক শল্যবিদ এবং অপরধারে এক কসাইকে একসঙ্গে দেখছি আমরা’। রজত ভাটিয়ার বোলিং নিয়ে মন্তব্য করছেন, ‘যে কোনও বোলারের তিন ধরনের বোলিং হয়, ফাস্ট, মিডিয়াম এবং স্লো, কিন্তু রজত ভাটিয়ার হয় স্লো, স্লোয়ার এবং স্লোয়েস্ট’।
ঠোঁটকাটা বয়কট যখন তাঁর অননুকরণীয় ইয়র্কশায়ারীয় উচ্চারণে বলছেন যে লর্ডসে শচীনের সেঞ্চুরি নেই, তখন হার্শা বলে উঠতে পারেন, ‘তাতে কার লোকসান? শচীন না লর্ডস?’ তিনি বলতে পারেন রাহুল সম্পর্কে, তাঁর অদম্য ব্যাটিং করার মানসিকতা সম্পর্কে, ‘দ্রাবিড়কে জলের উপর দিয়ে হাঁটতে বলা হলে জিজ্ঞাসা করবেন শুধু, কত কিলোমিটার?’ তিনি পূজারা সম্পর্কে বলতে পারেন, ‘ইয়ো ইয়ো হানি সিং-এর যুগে পূজারা এক দ্রুপদী সঙ্গীতবাদক’। এমন কত কত যে উতকর্ষ উপহার দিয়েছেন হর্ষ তাঁর সুদীর্ঘ ক্রীড়াভাষ্যকার জীবনে তার ইয়ত্তা নেই।
তাহলে হর্ষ ভোগলের বয়স কত? ১৯৯১-৯২তে যখন বায়োডেটা পাঠিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের হয়ে ভারত সিরিজে ধারাভাষ্য দিতে ছুটছেন তখন? তখন তো কেউ সাগরপারে যায়নি জবরখাকির কাছে। তাহলে বিল্লিগি আর শিঁথলের সঙ্গে হার্শাও সেই বাঁধভাঙা আলোআনয়নকারী লাইটব্রিঙ্গার। ভারতীয় ক্রিকেট ধারাভাষ্যকে যিনি তারুণ্য থেকে যৌবনে নিয়ে যাবার পথে হাত ধরেছিলেন।
আসলে আমরা আজ যৌবন পেরিয়ে যেতে চললাম। হর্ষ ভোগলের বয়স হয়নি। সেই বিরানব্বই বিশ্বকাপের উচ্ছ্বাস আজও ঝরে পড়ে, ঋষাভ পান্তের ব্রিসবেন জয়ের সময়। একই উদ্দীপনা নিয়ে তিনি হিরো কাপ ফাইনাল এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল প্রায় তিরিশ বছরের ব্যবধানে আমাদের সামনে আনতে পারেন। আর একই সংযম। ক্রিকেটের প্রতি অদম্য ভালবাসা, যা হয়তো আমাদেরই মতো বহু ক্লাব ক্রিকেটারের মতো রোহিন্টন বারিয়া ট্রফি বা স্থানীয় লিগেই জিয়া নস্টালে ডুবে যেতে পারত, তা জবরখাকিকে এক তলোয়ারে কাটতে পারে এই পঁয়ত্রিশ বছর পরেও।
বারবার বলেছেন, একএকটা সুযোগ এসেছে, আর তার সঙ্গে এসেছে না চলা পথের আশঙ্কা। কিন্তু সবসময়ই নিজেকে বুঝিয়েছেন, আইআইএমের যোগ্যতা আছে তো, এখানে কিছু না পেলে অন্যত্র তো পেতেই পারি। আর তাই শ্রান্তিহীন পথিকের মতো চলে গেছেন, যে পথ দিয়ে যায়নি কো কেউ।
তা এই পথে বাধাবিপত্তি কি আসেনি? এসেছে, সঞ্জয় মাঞ্জরেকরের মুখে শুনতে হয়েছে, আমরা যারা ক্রিকেট খেলেছি তারা বেশি বুঝির মতো কথা। ভারতীয় ক্রিকেট দলের অযথা সমর্থন না করে ভারতীয় সুপারস্টার (পড়ুন অমিতাভ বচ্চন), অধিনায়ক (অবশ্যই পড়ুন মহেন্দ্র সিং ধোনি) এবং বোর্ডের গুসসা মেনে নিয়ে নির্বাসনেও যেতে হয়েছে, চ্যাপেল-গাঙ্গুলি সাগায় আবেগের থেকে মস্তিষ্ককে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ভাগীরথীর পারের বহু সংস্কৃতিবানের রকের গালাগালের শিকারও হয়েছেন তিনি একবিংশ শতাব্দীর শূন্য দশকে।
তবুও তিনি চলেছেন, নিজস্ব আত্মাভিমান বজায় রেখে। নাসের হুসেইনের ফুটবল বিশ্বকাপে ভারতের যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার টিটকিরি জবাব হাসতে হাসতেই দিয়েছেন, ‘অন্তত: প্রতিবার প্রথম রাউন্ড থেকে হেরে আসতে তো হয় না’ বলে। টুইটারে আফগানিস্তানের প্রথম টেস্টে উৎসাহব্যঞ্জক টুইটের জবাবে টিটকিরি শুনতে হয়েছে যে তিনি নাকি পাকিস্তান বা আফগানিস্তানকে বেশি সমর্থন করেন ভারতের চেয়ে। কিন্তু অবিচল হর্ষ ফিরিয়ে দিয়েছেন উত্তর, ধারাভাষ্যকার হিসাবে নিরপেক্ষভাবে দেখাটা অত্যন্ত জরুরি, কর্তব্য। আর কর্তব্য থেকে পিছপা কেউই করতে পারেনি।
আর বর্তমানে? রাহুল দ্রাবিড় যেমন ক্রিকেট মাঠের আত্মগরিমার এক জ্বলন্ত উদাহরণ, মাঠের বাইরের ধারাভাষ্যকার হিসাবে হার্শা। হার্শার ছোট পুত্র আর দ্রাবিড়ের একই জন্মদিন তা তাঁর স্ত্রীর টুইটেই প্রকাশ পেয়েছে। শুধু ধারাভাষ্যকার নয়, ক্রিকেট কলাম লেখক হিসাবেও উইজডেন, ক্রিকইনফো সহ বিভিন্ন ম্যাগাজিন বা ওয়েব পোর্টালে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মর্যাদাবোধে পরিপূর্ণ ক্রিকেট বিশ্লেষণে বারবার আমাদের সামনে খেলাটাকে খোলা পাতার মতো রেখে দেন। তাতে ভাষা ব্যবহার আর বিশ্লেষণ শিক্ষণীয়।
তাহলে হার্শা ভোগলের বয়স কত? এক যৌবন ভালোবাসা নিয়ে যিনি আমাদের ক্রিকেট ভালোবাসতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার না হয়েও হৃদয় এবং মস্তিষ্ক দিয়ে খেলাটাকে আপন করতে শিখিয়েছেন যিনি তাঁর আসল বয়স কত? হায়দ্রাবাদ মিউনিসিপ্যালিটির, বেগমপেট শাখার পুরনো রেকর্ড বলবে যে আগামী জুলাই মাসে হর্ষ ভোগলে ষাটে পদার্পণ করবেন। কিন্তু আমরা জানি যে আমাদের পাকাচুল বা ফাঁকাচুলের বয়স দিয়ে হর্ষকে ধরা যাবে না।
রিপ ফন উইঙ্কলের মতো তিনি বারবার জেগে ওঠেন তিরিশ বছর আগের স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস, প্রজ্ঞা এবং আবেগ নিয়ে। গ্রাউন্ডহগ ডে-র বিল মারের মতো তিনিও আটকে আছেন এক অদ্ভূত টাইম ওয়ার্পে। আমাদের বয়স বেড়ে বেড়ে যায়, হার্শার বয়স বাড়ে না। ক্রিকেটকে অন্তর থেকে ভালোবাসার বয়স কি কখনও বাড়ে? হার্শা ভোগলেরও তাই বয়স হয় না। শুধু ক্রিকেটকে ভালোবাসা হয়। আর সেই ভালোবাসা দিয়েই প্রতি সকালে একইভাবে তিনি গলা সাধতে বসেন। প্রজ্ঞা বাড়ে, বয়স বাড়ে না হার্শার।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক