১৯৯৭ সালের সেই ভীতু বাংলাদেশকেই দেখতে চান হাতুরুসিংহে

১৯৯৭ এশিয়া কাপের একটি ম্যাচের ঘটনা মনে পড়ে গেল। শ্রীলঙ্কার তখন বিস্ফোরক ব্যাটিং লাইন আপ। টস জিতে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টিতে ৪৬ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে ৭২ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন সানাৎ জায়াসুরিয়া। শ্রীলঙ্কা ৪৬ ওভারে তুলেছিল ২৯৬ রান। বাংলাদেশ পুরো ৪৬ ওভার খেলে করেছিল ১৯৩।

১৯৯৭ এশিয়া কাপের একটি ম্যাচের ঘটনা মনে পড়ে গেল। শ্রীলঙ্কার তখন বিস্ফোরক ব্যাটিং লাইন আপ। টস জিতে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টিতে ৪৬ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে ৭২ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন সানাৎ জয়াসুরিয়া। শ্রীলঙ্কা ৪৬ ওভারে তুলেছিল ২৯৬ রান। বাংলাদেশ পুরো ৪৬ ওভার খেলে করেছিল ১৯৩।

ম্যাচের পর আর্জুনা রানাতুঙ্গা বলেছিলেন, টস হেরেও ব্যাটিং পেয়ে তারা অবাক হয়েছিলেন। পরে তারা ভাবলেন, বাংলাদেশ হয়তো রান তাড়ার চ্যালেঞ্জ নিতে চায় বা অন্তত সেই চেষ্টা করার একটা বার্তা দিতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের ঘুমপাড়ানি ব্যাটিং দেখে তার ভুল ভেঙেছিল। বাংলাদেশ আসলে চেয়েছিল নিরাপদ পথে হেঁটে ম্যাচটাকে যতটা সম্ভব লম্বা করতে।

শ্রীলঙ্কা যখন ছোট দল ছিল, বেশির ভাগ ম্যাচ হারত, তখনও তারা সাহসী ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করত বেশির ভাগ সময়। রানাতুঙ্গা বলেছিলেন, বাংলাদেশকেও উন্নতি করতে হলে সাহসী ক্রিকেট খেলা উচিত। অথচ ২৭ বছর পরও বাংলাদেশের খেলায় সেই ভীরু, পলায়নপর মানসিকতা দেখা গেল।

অনেকেই বলতে পারেন, বাংলাদেশ তো নিয়মিতই হারে। বিশ্ব আসরে সবসময়ই হারে। তাহলে আজকে ক্ষোভের এমন বিস্ফোরণ কেন? ব্যাপারটি হলো, ব্যর্থ হওয়া বা হেরে যাওয়া এক ব্যাপার, কিন্তু একটি সুযোগ থাকার পরও সেটি নিতে না চাওয়া বা ইচ্ছা না থাকা আরেক ব্যাপার।

একটা দলের সামনে বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনাল খেলার হাতছানি আছে, অথচ সেটা তাদের মূল লক্ষ্য নয়, অবিশ্বাস্য এই নজির আমরা দেখলাম।

আগের লেখায় লিখেছিলাম, ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত কীভাবে বলেছেন যে, দ্রুত তিন উইকেট হারানোর পর তারা সেমি-ফাইনাল খেলার আশা বাদ দিয়ে স্রেফ জয়ের চেষ্টা করেছেন। সেখানে অনেকেই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

পরে অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলন শুনলাম। সেখানে তিনি আরও বিশদভাবে বলেছেন দলের সেই পরিকল্পনার কথা, ‘এই ম্যাচ খেলতে আসার আগে আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ম্যাচটা আমরা আগে জিতব। এরপর যদি ওইরকম পরিস্থিতি হয়, তাহলে চান্সটা আমরা নেব, যেটা আমাদের হাতে ছিল, আমরা ওটা নিতে পারিনি এবং পুরো ব্যাাটিং গ্রুপ আমরা বাজে বাজে ডিসিশান নিয়েছি।’

তাহলে দেখুন, প্রেজেন্টেশনে বলেছেন, প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, মানে আসলেই এটা ছিল তাদের পরিকল্পনা। প্রথম পরিকল্পনা ছিল কোনোরকমে জেতা। এরপর পরিস্থিতি তৈরি হলে, সেমিতে খেলার চেষ্টা করা।

অথচ আগের রাতে অস্ট্রেলিয়ার হারের পর সমীকরণ বের করার বন্যা বয়ে গেছে সামাজিক মাধ্যমে। কেউ সিরিয়াসলিই আশা করেছেন, যারা মজা করেছেন এটা নিয়ে, তাদেরও মনের কোণে আসলে আশা লুকিয়েই ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনুসরণ করেন এবং ভালোবাসেন, এমন অনেকেই স্বপ্ন দেখেছেন, কিছু একটা হয়েও যেতে পারে, ক্রিকেটে কত কিছুই তো হয়!

অথচ আপনি যাদেরকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন, তারাই স্বপ্ন দেখছিল না। তাদের মূল চাওয়া ছিল কোনোরকমে জেতা! আগের লেখায় যেমন লিখেছি, এটা কি চরম প্রতারণা নয়?

যখন টিম মিটিং হচ্ছিল, যখন পরিকল্পনা করা হচ্ছিল, তখন কি কেউ ছিল না যে এটা বলবে, ‘সুযোগটা যেহেতু এসেছে, আমাদের অলআউট যাওয়া উচিত, সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করা উচিত সেমিতে ওঠার, তার পর জয়-হার যেটাই হোক, সমস্যা নেই।’

কেউ কি ছিল না এটি বলার? কোচিং স্টাফের কেউ? সাকিব-রিয়াদ-লিটন-সৌম্য-মুস্তাফিজ-তাসকিনের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারদের কেউ? অধিনায়ক? কিংবা একজন প্রধান কোচ কীভাবে এমন পরিকল্পনা করতে পারেন!

এখানে স্রেফ স্বার্থপর ভাবনা ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। দল কোনোরকমে ম্যাচ জিতবে। সব মিলিয়ে চারটি জয় হবে। কোচ বলবেন যে, ‘বোনাস একটা জয় পেয়ে গেছি, আমরা সফল’, অধিনায়কের প্রোফাইল ভারী হবে, সাকিবরা বলবেন যে, ‘চার জয় তিন হার, বিশ্বকাপ তো সফল’, ব্যস! সব মিলিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা হয়ে যাবে।

কিংবা টাকা-পয়সার ভাবনাও থাকতে পারে। ম্যাচ জিততে পারলে প্রাইজমানি আছে। সেমির চেষ্টা করতে গিয়ে উল্টো হেরে গেলে তো প্রাইজমানি হাতছাড়া! এমনকি, আজকে ধারাভাষ্যকারও এটা নিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। একটা দলের জন্য কত বড় লজ্জার ব্যাপার!

এই দুটি ছাড়া আর কোনো ব্যখ্যা মিলছে না। আবারও বলছি, এর চেয়েও বাজেভাবে দল অনেক ম্যাচ হেরেছে, এর চেয়েও বাজে টুর্নামেন্ট অনেক কেটেছে। কিন্তু আজকে এতটা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারণ, দল আজ দেশের জন্য জিততে চায়নি, নিজেদের জন্য জিততে চেয়েছে।

জানি না, এসবের কোনো জবাবদিহিতা চাওয়া হবে কিনা। ‘সুপার এইটে ওঠার সব বোনাস’ – কোচের এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যা কি চাওয়া উচিত নয়? দলের সাবেক অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাসন এটা নিয়ে চান্দিকা হাতুরুসিংহের দিকে তীর ছুড়েছেন। বোর্ড কি পারবে? ম্যাচে দলের পরিকল্পনা বা অ্যাপ্রোচের ব্যাখ্যা চাওয়া কি উচিত নয়?

যদিও হবে কচু। ২০২৩ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার তদন্তের নামে লোক দেখানো কিছু তর্জন-গর্জন শেষে কিছুই হয়নি। এবারও সময়ের স্রোতে এখানে পলি পড়ে যাবে। যে কোচকে হাতেপায়ে ধরে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তাকে কাঠগড়ায় তোলার সাহস কার আছে!

এই যে, স্টুয়ার্ট ল কিছুদিন আগে আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ হওয়ার, বোর্ড মিটিংয়ে তার নাম চূড়ান্তও হয়েছিল প্রায়, কিন্তু এরপর হুট করেই নিয়োগ দেওয়া হল এএচপির কোচ ডেভিড হেম্পকে। এখানে হেম্পের যোগ্যতা নিয়ে কিছু বলছি না। কিন্তু স্টুয়ার্ট ল তো প্রমাণিত সফল কোচ!

বাংলাদেশের প্রধান কোচ হিসেবে সফল ছিলেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বেও সফল। কিন্তু শোনা যায়, হাতুরুসিংহের চাওয়ায় ল-কে বাদ দিয়ে হেম্পকে নেওয়া হয়েছে। বোর্ডের কেউ কেউই বলেন, ব্যক্তিত্বের সংঘাত হতে পারে বা ভবিষ্যতে প্রধান কোচের দাবিদার হয়ে উঠতে পারেন বলেই নাকি ল-কে কোচিং স্টাফে রাখতে চাননি হাতুরুসিংহে। তো, এমন ক্ষমতা যে প্রধান কোচের, তার দিকে আঙুল তুলবেন কে?

অবশ্যই কোচ হিসেবে হাতুরুসিংহের ইতিবাচক অনেক কিছু আছে। রিশাদকে সুযোগ দেওয়ায় বড় কৃতিত্ব তার, আরও নানা কিছুতে কৃতিত্ব তার প্রাপ্য। কিন্তু যেখানে দায় নেওয়ার, যেসব জায়গায় অভিযোগ, সেগুলোও তো তুলতে হবে। কিন্তু তিনি সবার ধরাছোঁয়ার ওপরে।

এই বিশ্বকাপের পর শান্তকে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক রাখার একটি কারণও আর নেই। টেস্ট, ওয়ানডেতে আপাতত ঠিক আছে। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে তার সামগ্রিক ব্যাটসম্যানশিপে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এই সংস্করণে ফেরানো উচিত নয়।

তাছাড়া মূল ব্যাপার যেটি, আজকের ম্যাচের পরিকল্পনা ও অ্যাপ্রোচের কারণে যেমন কোচের কাছে যেমন কড়া জবাব চাওয়া দরকার, তেমনি অধিনায়কেরও আর এই সংস্করণের দায়িত্বে থাকার যোগ্যতা আছে বলে মনে করি না।

আর সংশ্লিষ্ট বোর্ড কর্তাগণ ও প্রধান কর্তা, বিসিবি সভাপতিকে নিয়ে আর কী বলব। বলতে বলতে আর অবশিষ্ট কিছু নেই। একেকটি ব্যর্থতায় ক্রিকেটার-অধিনায়ক-কোচ- টিম ম্যানেজমেন্টের নানা জনের নানা খেসারত দিতে হয়, কিন্তু কিছুই হয় না কেবল তাদেরই। তাদের কোনো ভুল নেই, ব্যর্থতা নেই। দল দেশে ফেরার পর তারা কিছুদিন হম্বিতম্বি করবেন, ব্যাপক হুঙ্কার ছুড়বেন, ‘অমুককে দলে ফেরাও তমুককে বাদ দাও’ – এই ধরনের কিছু নাটক সাজাবেন, চটকদার কিছু করে মূল ব্যাপার আড়াল করবেন। এরপর যে লাউ সেই কদু।

মাত্র ২০ বছর আগে এশিয়ার আঞ্চলিক লিগগুলোয় খেলা শুরু করেছে আফগানিস্তান, এই ২০০৮ সালেও তারা খেলত আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ফাইভে, ২০০৯ সালে খেলত ডিভিশন থ্রিতে, সেই দলটিই আজ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে।

অথচ বাংলাদেশের কাছে তা এখনও স্বপ্ন। কিংবা হাতছানি থাকার পরও বাংলাদেশ সেই স্বপ্ন দেখার সাহসও পায় না, ঠিক আজকের মতো। সমস্যা নাই। বোর্ড সভাপতি কয়েকদিন পর বলবেন, আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ভারত-শ্রীলঙ্কায়, এই কন্ডিশনে আমাদের ভালো সম্ভাবনা আছে, আমাদের আসল লক্ষ্য তো আগামী বিশ্বকাপ।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...