১৯০৫ সাল। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের ঘোষণার মাঝেই সমগ্র বাংলাজুড়ে চলছে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ। সক্রিয় রাজনীতির পথে হেঁটে রবীন্দ্রনাথ সঞ্জীবনী পত্রিকায় লিখলেন-
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
ওমা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…
স্বাধীনতা আন্দোলনের সলতে পাকানোটা শুরু হয়েছিল মহাবিদ্রোহ থেকে। তারপর কলকাতাসহ সমগ্র বাংলা হয়ে উঠল বিপ্লবীদের আঁতুরঘর।পরাধীন ভারতের রাজধানী কলকাতার বুকে একটার পর একটা বিল পাশ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছিল ব্রিটিশ সরকারের। বাংলাকে ভেঙে দিতে পারলেই হয়ত কাজটা অনেকটা সহজ হয়ে যেত তাঁদের জন্য। তাই বঙ্গভঙ্গের চেনা ছক।
কলকাতার পটলডাঙাস্ট্রিট দিয়ে বিপ্লবীদের মিছিলে পা মিলিয়েছেন অগুনতি সাধারণ মানুষ। শুরু হয়েছে স্বদেশি আন্দোলনের পরিকল্পনা। এর মাঝেই নিঃশব্দে লড়াই করে চলেছেন একটা লোক। শৈলেন বসু। ব্রিটিশ আর্মির চাকরি ছেড়ে লোকটা বেরিয়ে এল একটা ঝড়ের মতোই। দুচোখে তার অদ্ভুত প্রত্যয়!
১৯০০ সাল। কিরীটি মিত্রের মোহনবাগান ভিলা তখন ফুটবল দল। মোহনবাগান আথলেটিক্স ক্লাব। এই আথলেটিক শব্দটা অবশ্য নামকরণে সংযুক্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্সির বিলিতি প্রফেসর রো সাহেব। সে সময় তিন বনেদি পরিবারের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা ক্লাবটার প্রতি ব্রিটিশরাজের বেশ একটা সহানুভূতির হাত ছিল। ব্রিটিশরা চাইছিলেন বাংলার তরুণপ্রজন্ম যদি ফুটবল খেলাটায় মজে যায় তাহলে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লবী আসা কমে যাবে।
এই পরিকল্পনাটা প্রথম ধাক্কা খেল ১৮৯২ সালে। শোভাবাজার ক্লাব প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসেবে হারিয়ে দিল এক পরাক্রমী ব্রিটিশ দলকে। আঁতে ঘা লাগতেই একটু নড়ে চড়ে বসল ব্রিটিশরা। কিন্তু পরের সাত বছর আবার সব শান্ত। এদিকে ঐ বিরানব্বই-তে শৈলেন বসু প্রথম বুঝে গিয়েছিলেন ব্রিটিশদের পাতা ফাঁদে তাদেরই বন্দী করার জন্য দরকার একটা বিপ্লবের, আর সেই বিপ্লবই হল ফুটবল।
১৯০০ সালে ভূপেন্দ্রনাথ বসু ক্লাবে নিয়ে এলেন এই বেপরোয়া লোকটাকে। জন্মের প্রথম ১১ বছর মোহনবাগান ক্লাবে যে ভয়ংকর অভিজাত পরিবারের প্রভাব তা প্রথম ভাঙলেন শৈলেন। ক্লাবের নিয়ম ছিল ফুটবলটা খেলতে পারবে একমাত্র উচ্চশিক্ষিতরা। তাই মোহনবাগানে খেলতে গেলে ম্যাট্রিকুলেশান ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু শৈলেন বুঝেছিলেন ফুটবল খেলাটা আদতে এক নাগরিক বারুদ। ব্রিটিশদের বুদ্ধিতে এই খেলাকে যত উঁচু স্তরে ধরে রাখা হবে তত বিপ্লবের একটা ধারালো অস্ত্রকে তুণীতে তুলে রেখে ভোঁতা করে দেওয়া!
তিনি চারবছরে ক্লাবের খোলনলচে পাল্টে ফুটবলের সাথে নিয়ে এলেন আর্মির কঠোর ট্রেনিং পদ্ধতি যা তিনি শিখেছিলেন আর্মিতে থাকাকালীন। শুরু হল বিপ্লবের এক আদিম অস্ত্রে শাণ দেওয়ার কাজ। দলে এলেন বাংলার বিভিন্নপ্রান্ত থেকে ছেলেরা। আর ঠিক চারবছরের মাথায় মোহনবাগান জিতল তাদের প্রথম ট্রফি কোচবিহার কাপ। ১৯০৪ সালে।
১৯১১ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। ১৯১১ এর এই আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল ১৯০৪ সাল থেকে। শৈলেন বসু দলের দায়িত্ব দিলেন শিবদাস ভাদুরীকে। ১৯০৫,১৯০৭ সালে আবার কোচবিহার কাপ এল বাগানে। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশদের গ্ল্যাডস্টোন কাপে তৎকালীন শিল্ড চ্যাম্পিয়ন ডালহৈসি ক্লাবকে ৬-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হল বাগান।
এবার ক্রমশ কঠিন হতে লাগলেন ব্রিটিশরা। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ ব্যাক টু ব্যাক ৩ বছর ট্রেডস কাপও জিতে নিল শৈলেন বসু ও তাঁর ছেলেরা। ফুটবল খেলাটা ছড়াতে শুরু করল বাংলায়।বনেদি পরিবার ছেড়ে খেলাটা নেমে এল অলিতে গলিতে। সরকার চাপে পড়ে বাধ্য হল মোহনবাগানকে প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড দিতে।
নিজেদের খাসতালুক ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে৷ নিজেদের প্ল্যান এভাবে বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে দেখে এবার পাল্টা চাল দিতে শুরু করলেন ব্রিটিশরা। মোহনবাগান খেলোয়াড়রা কোনো ব্রিটিশ দলের বিরুদ্ধে ট্যাকল করলেই তাকে কঠিন শাস্তির মুখে ফেলতে শুরু করল কোম্পানি। এদিকে রবীন্দ্রনাথ তখন লিখেছেন –
ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে মোদের আঁখি ফুটবে
মোদের বাঁধন ততই টুটবে…
শৈলেন বসুর প্ল্যান এবার যেন বারুদ ছড়াতে শুরু করল কলকাতার বুকে। মোহনবাগান দুরন্ত ফুটবল খেলে জায়গা পাকা করে নিল তখনকার ১ নম্বর টুর্ণামেন্ট আই এফ এ শিল্ডে। শোভাবাজার, পটলডাঙা সহ উত্তরকলকাতায় মোহনবাগান একটা বিপ্লবের নাম হয়ে উঠল অচিরেই। শিল্ডে খালিপায়ে খেলতে হবে বাগানকে। বিষয়টা জানা ছিল বলেই হয়ত তেমন গা করেন নি ব্রিটিশরা। তারপরের গল্পটা সবারই জানা প্রায়।
কিন্তু এই ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময়তা এখানেই যে ব্রিটিশরাজের বিপক্ষে যে এগারো দামাল লড়ে গিয়েছিল তাঁদের মধ্যে মনমোহন মুখার্জি ছিলেন উত্তরপাড়ার, নীলমাধব ভট্টাচার্য ছিলেন শ্রীরামপুর, দলের হৃদপিণ্ড শিবদাস ও বিজয়দাস ভাদুরী ছিলেন ফরিদপুর, কানু রায় ছিলেন ময়মনসিংহের মানুষ, সুধীর চ্যাটার্জি ছিলেন ধর্মান্তরিত ক্রিশ্চান, ভূতি সুকুল ছিলেন অবাঙালি।
একদিকে ভেঙে যাচ্ছে বাংলা অন্যদিকে একটা এগারোজনের দলের ভেতর ক্রমশ ফুটে উঠছে অখন্ড ভারতের অবয়ব, এখানেই হয়ত সেদিনের মোহনবাগানের সবুজ মেরুণের উর্দ্ধে একটা জাতীয় পতাকা হয়ে ওঠার রূপকথা, যেখানে কোনো ধর্ম নেই, জাত নেই, বিভেদ নেই আছে শুধু একটা বেপরোয়া লড়াই-এর জেদ, যে ব্রিটিশরাজ বঙ্গভঙ্গের সময়ে পাঁচ বছরে কয়েক হাজার খুন আর ধর্ষণ করে বেলচায় করে তুলে নিয়ে যেত বিপ্লবীদের দেহ সেই বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে ইস্টইয়র্কশায়ারকে হারানোটা ছিল বিপ্লবের চিত্রনাট্যে ফুটবলের আত্মপ্রকাশ, ব্রিটিশ আভিজাত্যের ভেতর খেলাটাকে ডিনামাইটের মতো ভরে দেওয়া!
সেই ২৯ জুলাই ফাইনালের আগে ব্রিটিশ সরকার প্রথমবার কোনো খেলার জন্য স্পেশাল ট্রেন চালিয়েছিল, প্রথমবার ঢাকা, ফরিদপুর,জলপাইগুড়ি,বর্ধমান থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে এসেছিলেন, দরিদ্র মানুষ, বুভুক্ষু মানুষ, ব্রিটিশ সরকার নিজেদের দর্শকদের জন্য আনালেন বিলিতে চেয়ার আর সাধারণ ভারতবাসীর জন্য খোলা ময়দান, গাছের ডাল, ভাঙা পাঁচিল।
কীসের সেই টান? একটি বার স্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠা বিপ্লবের, তাকে স্বচক্ষে দেখার জন্য ছুটে আসছে মানুষ, এখানেই তাঁর সার্থকতাঠ
মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের বিজয়ী খেতাবটি এসেছিল লন্ডনের বিখ্যাত এলকিংটন কোম্পানি থেকে, এই জয়ের পর সারাবাংলাজুড়ে একটা বিশ্বাস জন্ম নিল, একটা স্ফুলিঙ্গ থেকে অগ্নিশিখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বিপ্লব! আর ঐ বছরই ডিসেম্বরে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে নিতে বাধ্য হল ব্রিটিশ সরকার!
১০৯ বছর পর সেই ব্রিটিশ মুলুকে উড়ছে মোহনবাগানের পতাকা। সেই ম্যাচের শেষ বাঁশিই ছিল আগাম বিপ্লবের শঙখধ্বনি, যা বেজেছিল ১০৯ বছর আগে, আর সেই বছরই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ভারতভাগ্যবিধাতার আদিমন্ত্র-
দারুণ বিপ্লব মাঝে, তব শঙখধ্বনি বাজে
সংকট দু:খ ত্রাতা,
জনগন পথপরিচায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্য বিধাতা…