একশো, দুশো, ‘হিট-শো’

গুরুনাথ শর্মা নিজের এক বছরের ছেলেকে ওর ঠাকুমা-দাদুর কাছে রেখে চলে এলেন দোম্বেভিলি-তে। মা পূর্ণিমার চোখের জল হেরে গেল গুরুনাথের কেয়ারটেকারের চাকরির সামান্য মাইনের কাছে। ছোট্ট রোহিত একটু বড় হতেই বুঝেছিল ওর লড়াই আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতো নয়, তাঁর চেয়ে অনেক অনেক কঠিন, ‘সাধারণ’ শব্দটার প্রতিটা বর্ণকে ছিঁড়ে ওকে অসাধারণ হয়ে উঠতে হবে, হবেই।

স্কুলে মাইনে জমা দিতে না পারায় ক্রমেই সমস্যা বাড়তে লাগল ছোট্ট রোহিতের জীবনে। বিকেলে সবার অলক্ষ্যে ক্রিকেটের মহড়া চলতে লাগল এক জীবন্ত স্বপ্নের। পাশে এসে দাঁড়াল দুই জেঠু, রোহিতের স্কুল ফিজ এর পাশাপাশি একটা ছোট্ট ক্রিকেট ক্যাম্পে ভর্তি করানো হল ওকে, ক্রিকেট কিটের সামর্থ্য না থাকায় একাডেমীর ফেলে দেওয়া প্যাড-গ্লভস আর শ্যু দিয়েই শুরু হল রোহিতের স্বপ্ন পূরণের লড়াই।

ক্যাম্পের কোচ দীনেশ স্যার লক্ষ্য করলেন রোহিতকে। মুম্বাইয়র হাজার হাজার ক্রিকেট ট্রেনির মধ্যে এই ছেলেটাই একমাত্র যে যেকোনো পিচে এফোরটলেসলি হিট করতে পারে। স্পিন কিংবা পেস, ডেলিভারির অপটিমাম সময়ে ব্যাটের স্ট্রোকটা খেলে দেয় ছেলেটা। কোনো শারীরিক শক্তি ছাড়াই ঐশ্বরিক টাইমিং-এ মুম্বাই শহরে যেন হাজার ওয়াটের আলো জ্বালাতে এসেছে একটা ছেলে।

কোচ দীনেশের ব্যবস্থা করে দেওয়া স্কলারশিপের টাকায় রোহিতের অ্যাডমিশন হল নতুন স্কুলে। দীনেশ বুঝেছিলেন হীরের সর্বোত্তম দ্যুতি ভারতীয় ক্রিকেটের মুকুটে বসাতে হলে দরকার পাকা জহুরী। তাই প্রসিদ্ধ কোচের ট্রেনিং-যাতে রোহিত পায় সে জন্য বদল হল স্কুল।

শুরু হল স্বপ্নের দৌড়!

এক আহত সিংহের গর্জনে ক্রমেই উত্তপ্ত হতে শুরু করল ভারতীয় ক্রিকেট। দেওধর-রঞ্জিতে দুরন্ত খেলে রোহিত এসে পড়লেন জাতীয় দলে। পাঁচ বছর প্রবল সমালোচনা। সকলে একবাক্যে মেনে নিল প্রতিভা থাকলেও এ ছেলের ধারাবাহিকতার অভাব আছে। তাই ২০১১ বিশ্বকাপ দলে জায়গা হল না।

কিন্তু রোহিতের জীবন আসলে ক্রিকেট ঈশ্বরের টাইমিং- মহড়ার বিচরণক্ষেত্র। রোহিত বুঝলেন তার লড়াই তার নিজের খামখেয়ালি মনটার সঙ্গে। রোহিত বুঝলেন ভারতীয় ক্রিকেটে বীরেন্দ্র শেবাগের ছেড়ে যাওয়া সিংহাসনে বসার প্রতিভা ঈশ্বর তাঁকে দিয়েছেন। তাই জীবনের মোক্ষম সময়ে রোহিত ডানা মেললেন, ব্যাটের ফেস টা খুলে দিয়ে খেললেন একটা ঐশ্বরিক স্কোয়ার কাট।

যতদিন ভারতীয় ক্রিকেট থাকবে ততদিন রোহিত শর্মা থাকবেন এক বিস্ময় প্রতিভা হয়ে যাকে নেট প্র্যাকটিস ছাড়া মাঠে নামালেও অবলীলায় ‘হিট শো’ উপহার দিতে পারেন, ততদিন রোহিত শর্মা থাকবেন কারণ ক্রিকেট ঈশ্বর নিজের সমস্ত অলংকার দিয়ে গড়েছিলেন সেদিনের সেই বাচ্চা ছেলেটাকে, ততদিন রোহিত শর্মা থাকবেন কারণ প্রতিটা বিতর্কের জবাব একটা ডাবল সেঞ্চুরি দিয়ে দিতে সকলে যে পারেন না।

সেদিন কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে আসছিল, ‘যদি শর্মা নিজের ফর্মে খেলা শুরু করেন, কোনো সুপার পাওয়ারও ভারতের বিশ্বকাপ জয় আটকাতে পারবে না।’

শচীনের মারাঠা সাম্রাজ্যের মুকুট ভারতীয় ক্রিকেটে স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল করে রেখেছে সেদিনের টাকার অভাবে ক্রিকেট কিট কিনতে না পারা ছেলেটা। সারা পৃথিবী একবাক্যে মেনে নিয়েছে শর্মা চলতে শুরু করলে ঝড় উঠবে। সেই ঝড়ে উড়ে যাবে প্রতিপক্ষ। সামান্য পুঁজি নিয়ে তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের এক ‘সুপারহিট শো’! 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link