২০১৬ সালের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। ২২ জন ক্রিকেটারের একটা বড়ো বহর নিয়ে নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয় বাংলাদেশ। দলে নবিশ হিসেবে কয়েকজনকে রাখা হয়। লক্ষ্য, তাঁদেরকে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাম্পে সুযোগ করে দেওয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো বিরুদ্ধ কন্ডিশনের সাথে আগেভাগেই পরিচয় করানো। ওই নবিশদের মধ্যে ছিলেন বর্তমান টেস্ট দলের সদস্য নাজমুল হোসেন শান্ত।
অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে টেস্ট সিরিজে আন্তর্জাতিক অভিষেকও ঘটে যায় শান্তর। অনাকাঙ্ক্ষিত বলছি কারণ নবিশ হিসেবে যাঁদেরকে দলের সাথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদেরকে ম্যাচ খেলানোর কোনো পরিকল্পনাই ছিল না টিম ম্যানেজমেন্টের। কিন্তু একের পর এক ইঞ্জুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ক্রাইস্টচার্চে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে নাজমুল হোসেন শান্ত ও নুরুল হাসান সোহানকে একাদশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ওই সময়টায় শান্তকে নিয়ে আমাদের ক্রিকেট পাড়ায় ব্যাপক উদ্দীপনা। তখন তিনি যুব ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ইন ফ্যাক্ট, সে রকর্ডটা এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। এসব রেকর্ড, পরিসংখ্যান, ব্যাটিং প্রতিভা ও দক্ষতা মিলিয়ে শান্তকে তখন অনেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ বলে মনে করতেন। এমনকি শান্ত নিজেও তাঁর প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখেন অভিষেক ম্যাচেই।
স্কোরকার্ডের সাক্ষ্যমতে, অভিষেক টেস্টের উভয় ইনিংসে ব্যাট করে তাঁর সংগ্রহ ১৮ ও ১২। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, এতে কী এমন প্রতিশ্রুতির আভাস পাওয়া গেল? এজন্যই বোধ হয় পরিসংখ্যানকে আস্ত গাধা হিসেবে একসময় অভিহিত করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে নেভিল কার্ডাস। কেননা, গাণিতিক সংখ্যা অনেকসময় একটা ইনিংসকে পুরোপুরি তুলে ধরতে পারে না৷ ঠিক যেমনটা পারছে না শান্তর ওই দুটি ইনিংসকে।
অভিষেক ইনিংসে শান্ত খেলেছিলেন ৫৬টি বল। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, এই ৫৬ বলের ইনিংসে আউট হবার আগ পর্যন্ত একবারও তাঁকে নড়বড়ে মনে হয়নি। যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন ততক্ষণ একটুও মনে হয়নি তিনি সংগ্রাম করছেন। সেদিন বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে ব্যাট চালিয়েছেন তিনি। একের পর এক বাউন্সারে আঘাত পেয়ে মুশফিক ও কায়েসের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের হাসপাতালে যাওয়ার ঘটনাগুলা একদম কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁদের এমন ভয়াবহ পরিণতির কারণেই একাদশে সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এসব বিষয় মনস্তাত্ত্বিকভাবে একটুও টলাতে পারেনি শান্তকে।
সেদিন বেশ সাবলীলভাবে বাউন্সারের বিপক্ষে ডাক করেছেন, অফস্ট্যাম্পের বাইরের বল ছেড়ে ছেড়ে খেলেছেন এবং নিজের আর্কে পাওয়া বলগুলা দৃষ্টিনন্দন শটে সীমানাছাড়া করেছেন। এখন যতই বলি বা লিখি, সরাসরি দেখে না থাকলে ওই ইনিংসটার সৌন্দর্য কোনোভাবেই বুঝানো সম্ভব নয়।
এবার বল আপনাদের কোর্টে। আপনারাই বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ না পাওয়া উনিশ না পেরোনো এক উপমহাদেশীয় যুবার জন্য কোনোপ্রকার মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই নিউজিল্যান্ডের মতো কঠিন কন্ডিশনে হঠাৎ সাউদি-বোল্ট-ওয়াগনারদের বিপক্ষে অত্যন্ত সাবলীলভাবে খেলা ১৮(৫৬), ১২(৬০) দুটি ইনিংস কি প্রতিশ্রুতির জানান দেয় না?
এরপর আসে ভারত সফর। নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরেই প্রথমবারের মতো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে ভারত সফর করে বাংলাদেশ। মাত্র এক টেস্টের ওই সফরে সংগত কারণেই দলে ছিলেন না নাজমুল হোসেন শান্ত।
হায়দরাবাদে খেলা গড়ানোর আগে ঘটে যায় এক অভাবনীয় ঘটনা। সকল স্পটলাইট কেড়ে নেয় ভারতের একটা সিদ্ধান্ত। চোট কাটিয়ে দলে ফেরা অজিঙ্কা রাহানেকে একাদশে জায়গা দিতে গিয়ে সবশেষ টেস্টে ত্রিশতক হাঁকানোর পরেও করুণ নায়ারকে বাদ দেয় ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট। খেলা শুরুর আগের আধঘণ্টা এটা নিয়েই চলে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। এমনকি খেলা শুরুর পরেও ধারাভাষ্যকাররা এই আলোচনায় ব্যস্ত থাকেন।
যদিও এই আলোচনায় সরব উপস্থিতি ছিল না একজন ধারাভাষ্যকারের। তিনি নিউজিল্যান্ডের স্কট স্টাইরিশ। বরং শান্তকে কেন দলে রাখা হয়নি সে ব্যাপারে ছিলেন যারপরনাই সরব। খেলা শুরুর পর একাধিকবার এই বিষয়টা নিয়ে কথা তুলেন তিনি। নিউজিল্যান্ডে শান্তর ব্যাটিং দেখে স্টাইরিস এককথায় মুগ্ধ। সেজন্য শান্তর দলে না থাকাটা বেশ অবাক করেছিল তাঁকে। বলেছিলেন, ‘নাজমুল ইসলাম (হোসেন) শান্তকে দলে না দেখে আমি বিস্মিত। সবশেষ নিউজিল্যান্ড সিরিজে কাছ থেকে তাঁর ব্যাটিং দেখেছি। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো বাউন্সি কন্ডিশনে কোয়ালিটি ফাস্ট বোলারদের খেলতে নেমে তাঁর প্রতিরোধ এবং কিছু শট দেখে মুগ্ধও হয়েছি।’
শান্তর ওই ইনিংস দুইটা দেখে না থাকলে এবং আমার বর্ণনা বিশ্বাস না করলেও অন্তত স্টাইরিসের কথাগুলা ধর্তব্যে নিতে পারেন। আর আইপিএলের সময় ‘সিলেক্ট ডাগআউট’ অনুষ্ঠানটা দেখে থাকলে স্টাইরিসের ক্রিকেটজ্ঞান ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয় বলেই বিশ্বাস আমার।
এখন কেউ কেউ ভ্যাবাচ্যাকা খেতে পারেন। ভাবতে পারেন, নিউজিল্যান্ডে এত ভালোই যদি খেলে থাকে তাহলে ভারত সফরে দলে জায়গা পেল না কেন?
এর পেছনেও যৌক্তিক কারণ ছিল। আসলে শান্ত তখন ম্যানেজমেন্টের জাতীয় দলের ভাবনায় ছিলেন না। তবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় অবশ্যই ছিলেন। যে কারণে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাঁকে দলের সাথে করে নিউজিল্যান্ড সফরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর অভিষেকটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল এবং কেন তা তো ইতোমধ্যে বলেই ফেলেছি।
তারপর একে একে কেটে যায় ৪টা বছর। এ সময়টায় শান্তকে জাতীয় দলের জন্য প্রস্তুত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়েছে৷ এককথায় তাঁর পেছনে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেছে ক্রিকেট বোর্ড।
এরই মাঝে ২০১৮ সালে জাতীয় দলে ‘প্রকৃত অভিষেক’টা হয়ে যায় শান্তর। কেননা তখন সবরকম প্রস্তুতি সেরেই দলে জায়গা করে নেন তিনি। কিন্তু সেই ‘অভিষেক’র পর নিজের প্রতিভার প্রতি তিনি একদমই সুবিচার করতে পারেননি। সাদা বলের ক্রিকেটে ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খান টানা তিন বছর। লাল বলের ক্রিকেটে ফিরেও শুরুতেই কিছু একটা করে দেখিয়েছেন এমনটা নয়। টানা ব্যর্থতায় সেখানেও একাধিকবার দলে জায়গা হারান তিনি।
অভিষেকের পর থেকে দীর্ঘ ৪ বছর কাটিয়ে তবেই পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। বর্তমানে টেস্ট দলের এই নিয়মিত মুখ গেল বছর পাল্লেকেলেতে ১৬৩ রানের ইনিংস খেলে মূলত প্রথমবারের মতো নিজের সামর্থ্যের জানান দেন জাতীয় দলে। পরবর্তী জিম্বাবুয়ে সিরিজেও ছিল তাঁর শতক। সবশেষ পাকিস্তান সিরিজে ব্যর্থ হলেও দ্রুতই ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি চলতি নিউজিল্যান্ড সফরে।
এবার মাউন্ট মঙ্গানুইতে ৬৪ রানের একটা ভালো ইনিংস খেলে ফেললেন শান্ত। এই ইনিংসটাই দুর্দান্ত কিছু হতে পারত যদি এটাকে তিনি আরো লম্বা করতে পারতেন। তবে শুরুর দিকে বরাবরের মতোই নড়বড়ে ছিলেন তিনি। এটা একটা উদ্বেগের বিষয়। কন্ডিশন যেমনই হোক, ব্যাটিং-সহায়ক বা বোলিং, উইকেটে নেমেই নড়বড়ে থাকাটা যেন তাঁর জন্য অলিখিত নিয়ম! তাছাড়া অফস্ট্যাম্পের বাইরের বল তাড়া করে আউট হওয়ার প্রবণতাও তাঁর মাঝে বেশ প্রবল। আজও ঠিক একইভাবে গালিতে ক্যাচ তুলে তিনি সাজঘরের পথ ধরেছেন।
অথচ সেদিনের আনকোড়া শান্ত এবং আজকের পরিণত (বয়স ও অভিজ্ঞতা বিচারে) শান্তর মাঝে কত তফাৎ! আবারো মনে করতে হয় তাঁর সেই প্রথম টেস্টের কথা, ইনিংস দুইটার কথা, যেখানে তিনি একজন পুরোদস্তুর টেস্ট ব্যাটসম্যানের মতো ব্যাটিং করেছিলেন। অভিজ্ঞদের মতো দায়িত্ব নিয়ে প্রতিরোধ গড়েছিলেন কিউইদের শক্তিশালী বোলিং ইউনিটের বিপক্ষে।
এসব ছোটোখাটো কয়েকটা কারণেই গেল ৪ বছর সুযোগ পেয়েও সকলের আস্থার প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হন শান্ত। সবশেষ তিন সিরিজে ২টা শতক পেলেও তিনি যে ধারাবাহিক বা দলের নির্ভরযোগ্য একজন, তেমনটা বলার সুযোগ নেই। এই দুইটা শতক মূলত পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেতে এবং নড়বড়ে খুঁটিটা একটু শক্ত করতে সাহায্য করেছে তাঁকে।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা কেটেছে, পদ্মা-মেঘনার জল বহুদূর গড়িয়েছে। এখন শান্তর দায়িত্বশীলতার সাথে ধারাবাহিক হবার পালা। কেননা তাঁর ওপর সকলের যে পরিমাণ প্রত্যাশা সেগুলোর প্রতিদান দেওয়া যে এখনও বাকি!