জয়ী সে বীরের বুকে কান পেতে শোন…

তাহলে কে এই হনুমা বিহারি? ভারতীয় দলের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপে কেন এই ‘ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া একজন’ টিকে যান? কারণ, তিনি পরিশ্রমী। কারণ, তিনি কার্যকর। সেজন্যই তো হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে কাঁতড়াতে থাকার পরও মাঠের যুদ্ধে কোনো ছাড় দিলেন না। শুধু ছাড় দেওয়াই নয় বিজয়ীও তিনিই। ১৬১ বল ছিলেন উইকেটে। ড্র নিশ্চিত হওয়ার আগ অবধি কোনো অজি বোলারই ফেরাতে পারেননি তাঁকে।

তিনি বিরাট কোনো ব্যাটসম্যান নন। বিরাট কোহলির মত সৌন্দর্য্য, রোহিত শর্মার মত ‘হিটম্যান’ তিনি নন। আহামরী কোনো প্রতিভাধর তিনি নন। পৃথ্বী শ, মায়াঙ্ক আগারওয়াল কিংবা শুভমন গিলদের মত তাই তঁকে ‘নেক্সট বিগ থিঙ’ বলে না কেউ। চেতেশ্বর পূজারার মত ধৈর্য্যর প্রতীকও হতে পারেন না সব সময়।

তাহলে কে এই হনুমা বিহারি? ভারতীয় দলের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপে কেন এই ‘ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া একজন’ টিকে যান? কারণ, তিনি পরিশ্রমী। কারণ, তিনি কার্যকর। সেজন্যই তো হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে কাঁতড়াতে থাকার পরও মাঠের যুদ্ধে কোনো ছাড় দিলেন না। শুধু ছাড় দেওয়াই নয় বিজয়ীও তিনিই।সর্বশেষ বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির ম্যাচ বাঁচানোর সেই ম্যাচে  ১৬১ বল ছিলেন উইকেটে। ড্র নিশ্চিত হওয়ার আগ অবধি কোনো অজি বোলারই ফেরাতে পারেননি তাঁকে। অপরাজিত ছিলেন ২৩ রানে। ইনজুরির কারণে দৌঁড়াতে পেরেছেন সামান্য, চার থেকেই এসেছে ১৬ রান।

জুটি বাঁধেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সাথে। অশ্বিন-বিহারী জুটিই নিশ্চিত করে সিডনিতে ভারতের হাসি। ৬২ রানের জুটি, ২৫৯ বলে – কতটা অধ্যবসায় থাকলে বিপদ এড়িয়ে দিনের শেষ অবধি উইকেটে থাকা সম্ভব। এটাই তো টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য্য, আর তার শিল্পী হলেন বিহারিরা।

হনুমা বিহারির জাতীয় দলে আসার পথটাও কিন্তু সহজ ছিল না কোনো ভাবে। অভিষেক ২০১৮ সালের হলেও, গল্পটার শুরু সেই ২০১২ সাল থেকে।

সেবার যুব বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দল ছিল ভারত। ধারণা ছিল, সেই প্রজন্মটাই কালক্রমে ভারতের মূল দলে জায়গা করে নেবে। আদতে তা হয়নি।

সেই টুর্নামেন্টে ভারতের নায়ক ও ফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান উন্মুক্ত চাঁদকে এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দলগুলোও আর ডাকে না। নিজের ছায়া হয়েই আছেন তিনি। স্মিত পাটেল, বিজয় জলরাও কড়া নাড়তে ব্যর্থ হয়েছেন।

রঞ্জির সুবাদে রুশ কালারিয়া ও আইপিএলের সুবাদে সন্দীপ শর্মার নাম কালেভদ্রে শোনা যায়। হনুমা বিহারিও ছিলেন এদের কাতারেই। এমন অসংখ্য ক্রিকেটারের জন্ম দেওয়া ভারত ঠিক এদের মূল দলের জন্য বিবেচনা করে না।

তবুও কি করে যেন রাডারের বাইরে থেকে এসে ভারতের টেস্ট স্কোয়াডে ডাক পেয়ে গেলেন হানুমা বিহারি। সেটাও আবার বিরুদ্ধ ইংলিশ কন্ডিশনে গল্পটা ঠিক সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়, তবে সিনেমার থেকে কমও নয়। ২০১২ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার ছয় বছর পর ভারতের জাতীয় দল – এই সময়টায় অনেক উত্থান পতন এসেছে বিহারির জীবনে।

বরাবরই বয়সেই তুলনায় একটু বেশিই পরিপক্ক ছিলেন হনুমা। বয়স যখন ১২ তখনই বাবা ও কোচ সত্যনারায়ন মারা যান। ওই বয়সে বাবার মৃত্যুর ঘণ্টা দুয়েক বাদে মাঠে নেমে খেললেন ৮২ রানের এক ম্যাচ জেতানো ইনিংস।

ক্রিকেটের মাঠের সাথে এই বাবাই তাঁকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হায়দরাবাদের জিমখানা মাঠে গিয়ে ক্ষুদে হনুমা অনুশীলন করতে দেখতেন আম্বাতি রাইডুকে। তাঁর অন ড্রাইভ আর স্কয়ার অব দ্য উইকেটের শটগুলোতে মুগ্ধ হতেন। তবে, হানুমা নিজের আদর্শ মানতেন ভিভিএস লক্ষণকে। বলা ভাল, এখনো মানেন।

সর্বডানে আবাহনীর বিহারি

জাতীয় দলে ডাক পেয়েই তাই স্মরণ করলেন লক্ষণকে। বললেন, ‘আপনি যখন হায়দারাবাদ থেকে উঠে আসবেন, অবশ্যই আপনার জন্য একটা বড় অনুপ্রেরণার নাম হবে ভিভিএস লক্ষণ। তিনি হায়দ্রাবাদ ও ভারতীয় ক্রিকেটের একজন লিজেন্ড। আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি লক্ষ্মণ স্যারের সাথে কিছু ম্যাচও খেলেছি। এটা আমার জন্য খুব উপকারী ছিল। তিনি আমাদের মেন্টর ছিলেন। আমরা টি-টোয়েন্টি ও আমার ব্যাটিং নিয়ে অনেক আলাপ করেছি।’

হ্যা, এই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই হল হনুমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ২০১৫ সালে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ দলে হনুমার সতীর্থ ছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। সেই সাঙ্গাকারা অবধি বলে গেছেন, ভারতের তরুণদের মধ্যে এত প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান তিনি আগে দেখেননি।

এই ব্যাপারটা ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের কে বোঝাবে! তারা তো বোঝেন কেবল সাফল্য আর স্ট্রাইক রেট। সেই মৌসুমে আইপিএলে হানুমার ব্যাটিং গড় ছিল মোটে ৯.৭৫। ব্যাস, এরপর জাতীয় দলে আসার আগে আর কখনোই আইপিএলে দেখা যায়নি তাঁকে!

এখানে তিনি থেমে যেতে পারতেন। কিন্তু, থামেননি। ওই যে, পরিশ্রম করাটা বন্ধ করেননি। প্রমাণের জন্য বেছে নিলেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। রঞ্জি কিংবা বিজয় হাজারে – মঞ্চটা যাই হোক না কেন – রান করেছেন বিস্তর।

আত্মবিশ্বাসের ব্যাপ্তিটা বেড়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভারতীয় ‘এ’ দলের সফর থেকে। আর সেটাই তাঁর জন্য খুলে দেয় ভারতীয় জাতীয় দলের দুয়ার। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়া এবং ওই ভিন্ন কন্ডিশনে নিজের প্রথম দেশের বাইরের সফরে পারফরম করা; ওই সফরে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আমি জানি, এরপর কী হতে যাচ্ছে। আমি জানতাম, আমাকে এ-দলে ফিরে আসতে ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক রান করতে হবে। আমার ওখানে একটা মাত্র ইনিংস ছিল, যেখানে আমি ভালো করিনি। তারপরও আমি জানতাম, আমাকে অনেক রান করতে হবে। কারণ, আপনি জাতীয় দলে খেলতে চাইলে, এ-দলে ভালো করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর আমাকে খুব উপকৃত করেছে। বিশেষ করে রাহুল (দ্রাবিড়) স্যার খুব সহায়তা করেছেন। তার সাথে এটা আমার প্রথম সফর ছিল।’

হানুমা এর মধ্যে খেলে গেছেন বাংলাদেশেও। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে আবাহনী’র হয়ে খেলেছেন মাশরাফি, নাসির, মিরাজদের সাথে। ম্যাচ জেতানো ইনিংসও আছে কয়েকটা।

এর ক’দিন বাদেই ডাক আসে জাতীয় দলে। দেশের মাটিতে খুব একটা খেলার সুযোগ হয় না। দেশের বাইরে অবশ্য তিনি দলের নিয়মিত মুখ। ওভাল, কিংস্টন, ক্রাইস্টচার্চ হয়ে সেই হনুমার সেই পতাকা এখন সিডনিতে। উড়তে থাকুন বিহারি ও তাঁর পতাকা!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...