আন্দ্রে রাসেল জায়গায় দাঁড়িয়ে অনায়াসে ছক্কা হাকাচ্ছেন। এমন দৃশ্য নিশ্চয়ই মুগ্ধতা ছড়ায়। আমাদের মনে হয় কত সহজেই তো ছক্কা হাঁকানো যায়। তবে এর পেছনে যে কত অনুশীলন রয়েছে তাঁর খবর কয়জনই রাখি আমরা। একটু ভিন্নধর্মী অনুশীলনও করতে হয় এমন দানবীয় শট মারতে হলে। নিজের সে টোটকা তিনি তাঁর উত্তরসূরীদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
আন্দ্রে রাসেল দুইটি কোণের সাহায্যে অনুশীলন করতেন। একটি কোণ রাখছেন স্ট্যাম্প আর তাঁর পেছনের পায়ের মাঝবরাবর আর দ্বিতীয়টি রাখতেন নিজের সামনের পায়ের ঠিক সামনে। এভাবেই তিনি স্বল্প জায়গায় ভারসাম্য রেখে পেশিশক্তির ব্যবহার করে অনুশীলন করতেন। আর তাঁর ফলাফল তো মাঠের ক্রিকেটেই দেখা গিয়েছে সচারচর। আর তাঁর সেই টোটকা এখন অনুসরণ করছেন ক্যারিবিয়ান তরুণ ক্রিকেটার ফ্যাবিয়ান অ্যালান।
এমন কত নিত্যনতুন অনুশীলন পদ্ধতি, প্রযুক্তির ব্যবহার যে যুক্ত হয়েছে ক্রিকেটের সাথে তাঁর যেন কোন হিসেব নেই। প্রযুক্তির বিপ্লবের সাথে পাল্লা দিয়ে বিপ্লব ঘটছে ক্রিকেটেও। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হচ্ছে ক্রিকেটের সংস্করণ। এই ক্ষুদ্র সংস্করণের চাহিদা ভিন্ন, তাই অনুশীলনেও আসছে ভিন্নতা, বৈচিত্রতা। এই যে আন্দ্রে রাসেলের অনুশীলন কৌশলই তো সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
তাছাড়া বাকি থাকা বিভিন্ন খেলাধুলার অনুশীলন থেকেও ক্রিকেটে আসছে নতুন সব অনুশীলনের পন্থা। মূলত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সাথে পাল্লা দিতেই এমন সব আয়োজন। শক্তিমত্তা বৃদ্ধি, ভারসাম্যতা রক্ষা, সহিষ্ণুতা, স্ট্যামিনা এসব কিছু বৃদ্ধিতেই এখন হাতে নেওয়া হয়েছে নতুন সব অনুশীলন কৌশল। টি-টোয়েন্টির এই জামানায় ‘পাওয়ার হিটিং’ এখন রীতিমত ‘হট টপিক’।
পেশিশক্তি ব্যবহার করা খেলোয়াড়দের বাড়তি একটা চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে পুরো বিশ্বজুড়েই। সে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে ব্যাটাররা নিত্যনতুন কৌশলে অনুশীলন করে নিজেদেরকে শানিত করছেন। এই যেমন ভারী ব্যাট ও বল ব্যবহার। নতুন এই কৌশলে অনুশীলনের প্রধান কারণ পাওয়ার হিটিং সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। বর্তমানে ব্যাটাররা অনুশীলনে খানিকটা ভারী ব্যাট ব্যবহার করে থাকেন।
যাতে করে সে ব্যাট দ্বারা বলকে আঘাত করতে একটু বাড়তি শক্তি উদপাদনের প্রয়োজন হয়। এই বাড়তি শক্তিটুকুই পরবর্তীতে ম্যাচের মাঝে ব্যাটারদের সহয়তা করে। যেহেতু সেখানে অপেক্ষাকৃত কম ওজনের ব্যাট দিয়ে খেলতে নামেন ব্যাটাররা। ঠিক তেমনিভাবে তাঁরা ভারী বলও ব্যবহার করে থাকেন। এতে করেও সে শক্তি উদপাদন বাড়ে। এই ধরণের অনুশীলন বছর কতক আগেও খুব একটা জনপ্রিয় ছিলনা।
তবে বর্তমান সময়ে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সদ্য সমাপ্ত হওয়া ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে দূর্দান্ত পারফরম করা এনামুল হক বিজয় এই পন্থা অবলম্বন করে সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। ব্যাটিংয়ে সাফল্যের জন্যে যেমন পেশিশক্তির দরকার ঠিক তেমনি দরকার ভারসাম্য রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যে রয়েছে আলাদা সব অনুশীলনের নিয়ম। একটা তো আন্দ্রে রাসেল মোটামুটি জনপ্রিয় করেই ফেলেছেন।
সেটা ছাড়াও এক পায়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভারসাম্য রক্ষার অনুশীলন করছে খেলোয়াড়েরা। তাছাড়া নির্দিষ্ট উচ্চতায় থাকা একটা বাঁধা পেরিয়ে লাফ দিয়েও ভারসাম্য অনুশীলনে মনোনিবেশ করেছে খেলোয়াড়েরা। ‘রেসিস্টিং ব্যান্ড’ দিয়ে দৌড়েও ভারসাম্যে অনুশীলন করতে দেখা যায়। তাছাড়া ‘রানিং বিটুইন দ্য উইকেট’ আরও বেশি দ্রুততার সাথে করতেও এই রেসিস্টিং ব্যান্ডের অনুশীলন বেশ কার্য্যকর হিসেবেই প্রমাণিত হচ্ছে।
তাছাড়া দ্রুত রান নেওয়ার জন্যে খেলোয়াড়েরা নিয়মিত ‘স্প্রিন্ট’ অনুশীলন করছেন। স্বল্প দূরত্বে নিজের গতি মুহূর্তে শূন্য থেকে বাড়িয়ে নেওয়াতে বিন্দুমাত্র অনীহা যেন নেই খেলোয়াড়দের। থাকার কথাও নয়। এই যুগ তো চরম প্রতিযোগিতার এক যুগ। এই যুগে আপনি অনুশীলনে গাফিলতি করা মানেই আপনি বাকি সবার থেকে পিছিয়ে পড়বেন। আর ছিটকে যাবেন স্বপ্ন যাত্রা থেকে।
সেটা হতে দিতে নারাজ বর্তমান সময়ের অধিকাংশ ব্যাটাররা। তাঁরা জানেন ঠিক কতটা প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন। তাঁরা জানেন খানিক পা হড়কে গেলেই কতটা বড় খাদে পড়ে যেতে হবে তাঁদের। এসব কিছুর পাশপাশি খেলোয়াড়রা নিজেদের ডায়েটে ব্যাপারেও হয়েছেন বেশ সতর্ক। এই সতর্কতার সাথে যুক্ত হয়েছে নিয়মিত জিম। এই দুই মিলে খেলোয়াড়দের সহিষ্ণুতা বাড়ছে।
খেলোয়াড়দের এখন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিশ্বের নানান প্রান্তের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সব টুর্নামেন্ট খেলতে ভিন্ন কন্ডিশনে বিরুপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সে সব পরিস্থিতিতে দ্রুতই নিজের শরীরকে মানিয়ে নেওয়াটাও একটা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। আর খেলোয়াড়রা সে চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেদেরকে সবসময় ফিট রাখতে ব্যবহার করছেন নানানরকম প্রযুক্তি। যেমন ‘জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম’ ব্যবহার করে খেলোয়াড়দের সক্ষমতা ও ‘ওয়ার্কলোড’ পরিমাপ করা হচ্ছে।
খেলোয়াড়দের প্রতিটা পদক্ষেপের পরিমাপ করা হচ্ছে। সে খেলোয়াড়ের গড় সক্ষমতা নির্ণয় করার পাশপাশি সে ঠিক কতটা কাজ করছে বা তাঁর উপর কাজের চাপ পড়ে যাচ্ছে কি না সেটাও পরিমাপ করা যাচ্ছে। এমন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ব্যাটাররা নিজেদের সামর্থ্য যেনে নিতে পারছে। এমনকি সে অনুযায়ী নিজেদের অনুশীলনেও তারতম্য ঘটাচ্ছেন তাঁরা। নিজেরদের মত করেই বাড়িয়ে নিতে পারছেন দক্ষতা, সহিষ্ণুতা।
অন্যদিকে এত কিছুর পরও হয়ত একজন ব্যাটার ভাল করতে পারবেন না যদিনা সে পর্যাপ্ত বিশ্রাম পায়। আর তাছাড়া খেলা শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে যদি খেলোয়াড়দের পেশিগুলোকে শিথিল পরিস্থিতিতে না নিয়ে আসা যায় তবে সেখানেও শঙ্কা থেকে যায় ইনজুরির। বিশেষ করে পায়ের। এ জন্যে এখন ‘নর্মাটেক বুটস’ নামক এক যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। এটা কোমর অবধি পা’কে আবৃত করে ইলেক্ট্রিক নোড ব্যবহার করে ম্যাসাজ করে। যার ফলে কোন রকমের বাড়তি ঝক্কি ছাড়াই পেশিগুলো শিথিল হয়।
এছাড়াও বিশ্রামের সর্বৌত্তম পন্থা হচ্ছে ঘুম। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত একজন খেলোয়াড় তাঁর প্রয়োজন মত ঘুমাতে পারলেই তবে সে মাঠের খেলায় নিজের সেটা দিতে পারবে। এটাও দেখা গেছে কোন কোন ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের প্রায় দশ ঘন্টা পর্যন্ত ঘুম তাঁদের সক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে খানিক বেশি।
তাছাড়া সঠিক অনুশীলনে পাশপাশি নিজেদের ভুল গুলো নিয়ে বর্তমান সময়ের ক্রিকেটাররা বেশ সতর্ক। তাঁরা তাঁদের ভুল শুধরে নিতে সদা প্রস্তুত। তাঁরা ভিডিও পর্যালোচনার মাধ্যমে নিজেদের ভুল শনাক্ত করেন এবং সেটা শুধরে নেওয়ার কাজ করে যান। এভাবেই এই প্রতিযোগিতার যুগেও ব্যাটাররা পারফরম করছেন ও টিকে থাকছেন।
– ক্রিকেট মান্থলি অবলম্বনে