পেশাগত ভাবে না হলেও, নেশাগত ভাবে নিজেকে ক্রীড়া সাংবাদিক মনে করতে দিব্যি লাগে। এবং এমন একটা টেস্ট ম্যাচের পর, অনুভূতিগুলো টাটকা থাকতে থাকতে একটা কিছু লিখে ফেলার অদম্য একটা ইচ্ছা জাগে। কাজেই চন্দ্রশেখর জাদুর ৫০ বছর পূর্তিতে ভারতের ওভাল বিজয় নিয়ে কিছু কথা লিখে গেলাম।
- কোহলির দল নির্বাচন নীতি
গত পাঁচ ছ বছর ধরে কোহলিকে অধিনায়ক হিসাবে দেখছি। পেস বোলারদের সাহস দেওয়া, ফিটনেসে জোর দেওয়া ছাড়া আরেকটি কোহলি নীতি আলোড়ন সৃষ্টি করার মতো । পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে দল নির্বাচন নীতি। কোহলির কিছু পূর্বসূরি চরম সফল অধিনায়ক (ওয়া ,লয়েড, পন্টিং ইত্যাদি) বিশ্বাস করতেন একই দল ধরে রাখতে। এবং টেস্ট ক্রিকেটে সফল হবার অন্যতম কারণ হিসাবেও মাঝে মাঝে এই নীতির গুণগান শোনা যায়।
কোহলির ভারত মোটামুটি সেই চিন্তাধারাকে এই সিরিজের পর টেমসের জলে ভাসিয়ে দিলো। অশ্বিনকে এই ম্যাচে দলে রাখলে কি হতো সেটা এখন আর বলা সম্ভব নয়। আমি এখনো ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি অশ্বিনের প্রতিটা টেস্টেই খেলা উচিত ছিল। কার জায়গায় জিজ্ঞেস করলে মুশকিলে পরবো। কিন্তু কোহলির সাফল্যের সাথে তর্ক করা বৃথা।
কোহলির এই হর্সেস ফর কোর্সেস নীতির পিছনে দুটো সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে। এক, ভারতের অসাধারণ রিজার্ভ বেঞ্চ। ইয়ান চ্যাপেল লিখেছেন, ভারত গত বছর দুয়েক ধরেই তাদের বিপুল জনসংখ্যার সাহায্যে এই বেঞ্চ তৈরি করেছে। ক্রিকেট ভারতে এক নম্বর খেলা। কাজেই যে পরিমান ছেলেপিলে ভারতে ক্রিকেট খেলতে আসে, অন্যান্য ক্রিকেট খেলিয়ে দেশে হয়তো অত জনসংখ্যাই নেই।
দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হিসাবে, প্রথম একাদশের ধারাবাহিকতাহীনতার কথাও বলা যেতে পারে। ওয়া, লয়েড বা পন্টিংয়ের প্রথম একাদশ এতো সব তারকায় ভরা ছিল, যে তাঁদের সরিয়ে অন্য কারুর আসার জায়গা তৈরি হতো না। কোহলির দলে কখনো খারাপ ফর্ম, কখনো চোট, ইত্যাদি নানান কারণে রিজার্ভে থাকা খেলোয়াড়দের সুযোগ হয়েই যায়।
- প্রসঙ্গ রাহানে
একসময় রাহানের হয়ে যথেষ্ট গলা ফাটিয়েছি। এবং সঙ্গত কারণেই। ২০১৯ থেকে ২০২১-বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম সাইকেলে রাহানেই ছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ স্কোরার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া সফর পরবর্তী রাহানে এতটাই নড়বড়ে যে হাজার গলা ফাটিয়েও সঙ্গত যুক্তি খাড়া করা যাবে না রাহানের দলে টিকে থাকার।
এখানে পাল্টা যুক্তি আসতে পারে, কোহলি ও পুজারাও সমানভাবে খারাপ খেলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে, রাহানের খেলার ধরণ। লর্ডসে যে ৬১ করলেন সেটাতেও সুযোগ-আধা সুযোগের গল্প আছে। তাঁকে দেখে কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ও ফর্ম দুটোরই চরম অভাবে ভুগছেন রাহানে।
বিরাট কোহলি সেখানে আকর্ষণীয় ব্যাট করতে করতে হঠাৎ একটি বিচ্যুতির কারণে আউট হয়ে যাচ্ছেন। পুজারাও অনেকাংশে তাই। কাজেই রাহানেকে এই সিরিজের পর দলে দেখলে খানিকটা অবাক হবো বৈকি। তিনি এবছরের রঞ্জিতে ভালো খেলে আবার দলে ফিরে আসুন, এই আশায় বুক বাঁধি।
- ‘অ’স্বাভাবিক খেলা
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে হারের পর লিখেছিলাম, স্বাভাবিক খেলার আড়ালে কিছু খেলোয়াড়ের ব্যর্থতা চাপা পরে যাচ্ছে। অমুক খেলোয়াড় ওরকমই খেলে, ওকে দোষ দিও না জাতীয় যুক্তি অন্তত আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এবং কেন নয়, সেটা এই টেস্টেই প্রমাণিত হলো।
ঋষাভ পান্ত পরিস্থিতি অনুযায়ী খেললেন। পুজারাও। এবং যার কথা বলতেই হবে তিনি রোহিত। শুধু এই টেস্ট নয়, এই সিরিজে রোহিত যা খেলছেন তা এক কথায় অসামান্য। আমি নিজেও রোহিত বিলেতে কেমন খেলবেন এই নিয়ে সন্দিহান ছিলাম।
রোহিত এখানে তাঁর স্বাভাবিক খেলার থেকে অনেকটাই বিরত ছিলেন। শুধু স্বাভাবিক আক্রমণাত্মক ব্যাপারটা চেপে রেখে ধৈর্য্যশীল খেলাই নয়। একটা ছোট্ট টেকনিক্যাল বদলও তিনি করেছেন। আগে দেশ-বিদেশ নির্বিশেষে রোহিতের একটা ফরোয়ার্ড প্রেস ছিল। ওজনটা আগে থেকেই সামনের পায়ে থাকতো। অনেকের ক্ষেত্রে এটা দারুন কাজ করে। যেমন ক্যালিস।
কিন্তু, রোহিতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়। বেশির ভাগ বলেই তিনি এক্সট্রা কভারের দিকে খেলে ফেলতেন। ফলে ব্যাট-বলের মাঝে একটা ফাঁক তৈরি হতো। এখন তিনি ওই ফরোয়ার্ড প্রেসটা করছেন না। ফলে খুব সুন্দর জায়গায় বলটা খেলতে পারছেন।
এছাড়াও ইদানিং অনেক বেশি স্ট্রেট ব্যাটে খেলছেন। এই টেকনিক্যাল ব্যাপারটা যাঁরা একটু উচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন তাঁরা আরো ভালো বোঝাতে পারবেন। তবে রোহিত যদি এই খেলা চালিয়ে যেতে পারেন, তবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও রোহিতের ওপর বাজি ধরা যায়। বিরাট রাজার মুকুটে ওই একটা পালকই তো বাকি। এবং ভারতের টেস্ট সিরিজ জেতারও।