স্ট্রোকের বন্যায় অফ ফর্মের অন্যায়?

কিন্তু, তাঁর পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারার যে সমস্যা, সেটা যদি জাতীয় দলে এসেও অব্যাহত থাকে, তাহলে আরও একটা প্রতিভা বিনষ্ট হওয়ার আফসোসে পুড়তে হবে আমাদের। কারণটা বেশ স্পষ্ট। জিসানের মতো সহজাত স্ট্রোকমেকার খুব কমই যে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে!

সেই দিন খুব সম্ভবত বেশি দূরে নয়, যেদিন জিসান আলমকে নিয়ে ক্রিকেট পাড়ায় রাজ্যের আলোচনা হবে। হয়তো তাঁকে নিয়ে সাংঘাতিক হাইপও উঠবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তার আগেই গেল দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে জিসানকে অনুসরণ করে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর সম্বন্ধে আমার নির্মোহ পর্যবেক্ষণটা ভাগাভাগি করে রাখছি আজ।

প্রথমেই জিসান আলমের পরিচয়টা দিয়ে নিই। নারায়ণগঞ্জে জন্মানো বিশ না পেরোনো এই যুবা মূলত একজন ব্যাটিং অলরাউন্ডার। ব্যাটটা করে থাকেন ডান হাতে এবং একই হাতে টুকটাক অফ স্পিনটাও করতে পারেন। বর্তমানে তিনি মূলত ওপেনিংয়েই ব্যাট করেন, তবে তিন নম্বরে খেলারও বেশ অভ্যস্ততা রয়েছে তাঁর।

আদতে যুব ক্যারিয়ারে তিনি বেশিরভাগ ম্যাচেই তিন নম্বরে ব্যাট করেছেন। সবশেষ যুব বিশ্বকাপের আগের দুইটা টুর্নামেন্ট থেকে কেবল নিয়মিত ইনিংস ওপেন করতে শুরু করেন তিনি। এর আগ পর্যন্ত নিজের খেলা ম্যাচগুলার মধ্যে হাতেগোনা দুয়েকটা ম্যাচ বাদে বাকি সবগুলাতেই তিন নম্বরে ব্যাট করেন জিসান।

ক্রিকেটার পরিচয়ের পাশাপাশি জিসান আলমের কিন্তু আরও একটা পরিচয় রয়েছে, যে পরিচয়ে তিনি ইতোমধ্যে পরিচিত হওয়া শুরু করেছেন। তবে অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হওয়াটা আমি একদমই পছন্দ করি না, বিধায় তাঁর সে পরিচয়টা লেখায় উল্লেখ করতে পারছি না।

ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘নেক্সট বিগ থিং’ হওয়ার মতো সব ধরনের প্রতিশ্রুতি জিসান আলমের মধ্যে রয়েছে। আবার একইসাথে সেই প্রতিশ্রুতির বিকাশ না ঘটারও শঙ্কা আছে। বিষয়টা খোলাসা করছি। আগে জিসানের প্রতিশ্রুতি কিংবা সামর্থ্যের কথা বলে নিই।

ব্যাট হাতে জিসান আলম একজন মারকুটে ব্যাটার। প্রথম বল থেকেই বোলারদের ওপর চড়াও হয়ে খেলাটা তাঁর স্বভাবজাত।
এমনকি যে পজিশনেই ব্যাট করেন না কেন, প্রথম বল থেকে মেরে খেলতে বরাবরই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। তাছাড়া উইকেটে যতক্ষণ ব্যাটিং করেন, ততক্ষণই আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তিনি ব্যাট চালিয়ে থাকেন।

ইংরেজিতে ‘ফ্ল্যামবইয়ান্ট’ বলে একটা কথা আছে না, বাইশ গজের জিসান মূলত সে-রকমই একটা চরিত্র৷ উইকেটের চারদিকেই শটস খেলার সামর্থ্য রয়েছে তাঁর। জায়গায় দাঁড়িয়ে বড় বড় ছক্কাও হাঁকাতে পারেন তিনি। আর যতক্ষণ উইকেটে টিকে থাকেন, ততক্ষণ তাঁর ব্যাটিং থেকে চোখ সরানোও যেন দায়! সব মিলিয়ে দেখার মতো একজন ব্যাটার বলা যায় তাঁকে।

যদিও টেকনিক্যালি সলিড কোনো ব্যাটার নন জিসান! তাঁর পায়ের কাজ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। আবার সফলতা পেতে চাইলে যে টেকনিক্যালি সাউন্ডই হতে হবে, এমনও কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। যদি থাকত, তাহলে ক্রিস গেইল, সনাথ জয়াসুরিয়া, বীরেন্দ্র শেবাগ, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও ব্রেন্ডন ম্যাককালামরা ক্রিকেটবিশ্ব দাঁপিয়ে বেড়াতে পারতেন না।

সলিড টেকনিকের অধিকারী না হয়েও শুধু ‘হ্যান্ড-আই কোঅরডিন্যাশন’-এর মাধ্যমেই তাঁরা নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণ করেছেন এবং ক্যারিয়ার শেষে কিংবদন্তিদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তাই জিসানের মতো টেকনিকের দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা কাউকে ক্যারিয়ারের শুরুতেই খারিজ করে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

জিসানের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের একটা বড়ো বিজ্ঞাপন হলো তাঁর স্ট্রাইক রেট। যুব ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তিনি দলের মধ্যে সর্বোচ্চ ১২১.৬৮ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন। সবশেষ ডিপিএলে তাঁর স্ট্রাইক রেট ছিল ১৩৩.৭৫, যা টুর্নামেন্টে তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর গেল মাসে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টপ এন্ড টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে এইচপি দলের হয়ে ১২২.৮৫ স্ট্রাইক রেটে রান তুলেছেন তিনি।

তবে শুধু স্ট্রাইক রেট দিয়ে জিসানকে বিচার করলে সেটা হয়ে যাবে শুভঙ্করের ফাঁকি। একটা উদাহরণ দিই। যুব ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দলের ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটে জিসান ব্যাট করে থাকলেও সর্বনিম্ন গড়টা কিন্তু তাঁরই দখলে৷ সেখানে ২৪ ইনিংসে ২১.০৪ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৫০৫ রান। একই চিত্র দেখা যায় ডিপিএল ও টপ এন্ড টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। ডিপিএলে ১৩ ইনিংসে জিসানের সংগ্রহ ৩২১ রান, যেখানে তাঁর গড় মাত্র ২৬.৭৫। ওদিকে টপ এন্ড টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে ৮ ইনিংসে ২১.৫০ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ১৭২ রান।

মানে, সংস্করণ যেটাই হোক, জিসানের স্ট্রাইক রেট সব সময় ১২০-এর বেশি থাকলেও ব্যাটিং গড়টা ২০ থেকে ২৬-এর মধ্যে ওঠানামা করে। শুরুতে বলছিলাম না, তাঁর প্রতিশ্রুতি যেমন আছে, তেমনি সেটা বিকশিত না হওয়ারও একটা শঙ্কা আছে! শঙ্কাটা মূলত এখানেই; ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে না পারাটা। এখন পর্যন্ত তাঁর পরিসংখ্যান সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে।

আসলে কোনো রাখঢাক না রেখে বলতে গেলে, জিসানের মতো সহজাত স্ট্রোকমেকার বাংলাদেশে খুব কমই আছে এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট খুব কমই দেখেছে। সে হিসেবে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এমনিতেও টি-টোয়েন্টি সংস্করণে ওপেনিংয়ে আমরা এ-রকম একজন ব্যাটারের অভাবে ভুগছি দীর্ঘদিন ধরে। সেক্ষেত্রে জিসান আলম খুব ভালো একটা অপশন হতে পারেন।

কিন্তু, তাঁর পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে না পারার যে সমস্যা, সেটা যদি জাতীয় দলে এসেও অব্যাহত থাকে, তাহলে আরও একটা প্রতিভা বিনষ্ট হওয়ার আফসোসে পুড়তে হবে আমাদের। কারণটা বেশ স্পষ্ট। জিসানের মতো সহজাত স্ট্রোকমেকার খুব কমই যে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে!

Share via
Copy link