দুই এপ্রিল ২০১১। দিনটার কথা মনে আছে কি? মহেন্দ্র সিং ধোনির শেষ সেই ছক্কার কথা? নিশ্চয়ই ভুলে যাবার কথা নয়। সেদিন ধোনি হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে গলা ছেড়ে সেদিন সবাই মেতেছিল ‘ধোনি, ধোনি’ চিৎকার করে আনন্দ উল্লাসে মেতেছিল প্রায় ৩৫ হাজার দর্শক। ঠিক তেমনি আরেক দফা ‘ধোনি, ধোনি’ বলে চেচিয়ে পুরো স্টেডিয়াম মাথায় তুলেছিলেন দর্শকেরা। তবে সেদিন ধোনির বন্দনায় নয়, নবাগত এক উইকেট-রক্ষকের নিন্দায়।
ঋষাভ পান্ত তখন একেবারে তরুণ। বীজে অঙ্কুরিত হওয়া সজীব কাণ্ডের মত। তরুণ খেলোয়াড়, ভারতের মত এক দলের হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন তাও আবার আরেক পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। নার্ভটা সেদিন একটু গড়মিল করবে তেমনটাই তো স্বাভাবিক। স্নায়ুচাপটা নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারে পান্ত উইকেটের পেছেনে বেশ কয়েকটা ভুল করে বসলেন। এমনকি দলকে ভুল কয়েকটি ডিআরএস নিতেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। যা কিনা ভুল প্রমাণ হয়।
যে দর্শকেরা একটা দশক দেখে এসেছে বিদ্যুৎ গতির স্ট্যাম্পিং, সদা জাগ্রত এক প্রহরী তীক্ষ্ণ চোখ আর অপার্থিব বুদ্ধিদীপ্ততা তাঁদের কাছে তরুণ ছোকড়ার সেই সব ভুল গুল অসহ্যকর লাগাটা খুব স্বাভাবিক। তবে সময়ে পরিক্রমায় সবাই নিজেকে গুছিয়ে নেয়, ঋষাভ ও নিয়েছেন। বছর তিনেক আগে যেখানে তিনি দর্শকদের চোখের বালি ছিলেন সেই তিনি এখন দর্শকদের নয়নের মণি। হয়ে গেলেন শ্রীলংকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ সেরা।
অবশ্য এখানে তাঁর ব্যাটিং দক্ষতারও বেশ একটা ভূমিকা রয়েছে। তবে ভারতের মত একটা দলে শুধুমাত্র একটি দক্ষতা দিয়ে সিরিজ সেরার পুরষ্কার বাগিয়ে নেওয়াটাও যে বড্ড কঠিন। তাছাড়া টিকে থাকাটাও বেশ দুষ্কর। সে বার্তাটা হয়ত পৌঁছেছে ঋষাভ পান্তের কান অবধি অথবা তিনি নিজ থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তবে তাঁর মত একজন ভয়ডরহীন ব্যাটার পাওয়াটা ভারতের জন্যে অন্য এক মাত্রা যোগ করে।
কিন্তু সেই বছর তিনেক আগের নড়বড়ে ঋষাভ পান্ত কি করে এত পরিণত হলেন? এমন প্রশ্ন আসাটা নেহাৎ অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি ব্যর্থতার ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন এমনটাই অভিমত ভারতের সাবেক উইকেট-রক্ষক ব্যাটার সাবা করিমের। সাবেক এই নির্বাচক ও খেলোয়াড় বলেন, ‘তাঁর মধ্যে এখন আর ব্যর্থ হওয়ার ভয়টা নেই। সেটাই এখন তাঁকে উইকেটের পেছনে শান্ত থাকতে অনেক বেশি সহয়তা করছে। উইকেটের পেছনের দূর্দান্ত হতে হলে একটা শান্ত মস্তিষ্কের প্রয়োজন। স্নায়ুচাপকে দমিয়ে রাখতে পারলেই কেবল কিপিংয়ের স্কিলগুলোর যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব।’
ভারতের জন্যে সবচেয়ে স্বস্তির বিষয় পান্ত এখন লম্বা ফরম্যাটেও দারুণ উন্নতি করেছেন নিজের ব্যাটিং দক্ষতার পাশাপাশি উইকেটকিপিং দক্ষতারও। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে পান্ত ১৮৫ রান করেছেন। সেই সাথে ২৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার পাঁচটি ক্যাচ ধরেছেন। তাছাড়া তিনটি সুনিপুণ স্ট্যাম্পিং করেছেন। অতএব নিজের ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি যে তিনি তাঁর উইকেটকিপিং স্কিল নিয়েও কাজ করেছেন সেটা স্পষ্ট।
সাবেক উইকেটরক্ষক ও অনূর্ধ্ব ১৯ দলের কোচ চন্দ্রকান্ত পন্ডিত বলেছেন, ‘একজন তরুণ উইকেটরক্ষক হিসেবে উদ্দীপনা আর উত্তেজনার ফলে সাধারণত ভুল হতেই পারে। তবে কোন খেলোয়াড় যত খেলার সুযোগ পাবে সে ততবেশি নিজেকে শাণিত করতে পারবে। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে সব ধরণের বল মোকাবেলা করার সুযোগ মেলে।’ সেদিক থেকে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট বাহবা পেতেই পারে।
কেননা তাঁরা ভরসা রেখেছেন ঋষাভ পান্তের উপর এবং খারাপ সময়ে পাশে থেকেছেন। গেল বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেও উইকেটের পেছনে দারুণ পারফর্ম করেছেন ঋষাভ পান্ত। শ্রীলঙ্কা সিরিজ শেষে তাঁর প্রশংসাও করেছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। রোহিত বলেন, ‘তাঁর (ঋষাভ) কিপিং আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। তাছাড়া গেল বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও সে দারুণ করেছে। আর তাঁকে দেখে মনে হয়ে সে প্রতিবারই আরো উন্নতি করছে সে।’
শ্রীলঙ্কা সিরিজে কুশাল মেন্ডিসকে অসাধারণ এক স্ট্যাম্পিং করেছিলেন পান্ত। যেখানে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের করা একটা ড্রিফটার পুরোপুরি আড়াল করে রেখেছিলেন কুশাল। তবুও বলের লাইন লেন্থ আন্দাজ করে সে বল ধরে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি পান্ত। যা কিনা তাঁর একাগ্রতা আর নিজেকে আরো একটু পরিণত করার মানসিকতার প্রমাণ দেয়। তাছাড়া দিল্লি ক্যাপিটালসের সাথে যুক্ত সাবা করিম বলেছেন, ‘ম্যাচের মধ্যে যেসব বল তাঁর কাছে আসতে পারে সেসব বল অনুকরণ করে সে কঠোর অনুশীলন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।’
মানসিকতার পরিবর্তনের সাথেসাথে ঋষাভের টেকনিক্যাল দিকেও বেশ উন্নতি সাধিত হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। তাছাড়া মাঠে তাঁর সম্পৃক্ততা দিনকেদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের ব্যাটিং দিয়ে পান্ত এখন নিজের একটা আলাদা তৈরি করে ফেলেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সে দিকটা তাঁকে আরো বেশি সহয়তা করছে নিজের কিপিং দক্ষতাকে বাড়িয়ে নিতে।
মোদ্দাকথা ঋষাভ নিজেকে নিয়ে কাজ করছেন। শুধু ব্যাটিং নয় কিপিংয়েও এখন তাঁর মনযোগ। হয়ত একজন মহেন্দ্র সিং ধোনি পাওয়া যাবে না। তবুও একেবারেই নিরাশ হওয়ার মতো উপায় নেই ঋষাভের অলরাউন্ড পারফর্মেন্সে। তবে আরেকটু সময় প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় তো সময়।