কাঁটাতার বিঁধে আছে দু’টো দেশের মাঝে। একটা সময় সৌহার্দ্যের বাতাস বয়েছে দু’টো দেশেই। কিন্তু এখন যেন একে-অপরকে কটু কথা শোনাতে পারলেই স্বস্তি। ক্রিকেট ময়দানের বাংলাদেশ-ভারত লড়াই হয়, আর সোশ্যাল মিডিয়াতে চলে গালাগালির তুমুল কোন্দল, কি করে পরিস্থিতি এমনটা বেগতিক হল? এর দায় কার?
মোটাদাগে এই দায় মিডিয়ার, বিশেষ করে ভারতীয় ব্রডকাস্টিং মিডিয়া স্টার স্পোর্টসের। সেই ২০১৫ বিশ্বকাপের পরের ঘটনা। ‘বাচ্চারা এখন আর বাচ্চা নেই।’ বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করেই বানানো হয়েছিল সেই বিজ্ঞাপন। ঘরের মাঠে ভারতকে আতিথিয়েতা দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই সিরিজের আগে খানিকটা খোঁচা মেরেই বাংলাদেশের ক্ষততে পুনরায় আঘাত হানে স্টার স্পোর্টস।
২০১৫ বিশ্বকাপের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। সেবারের নকআউট ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত। সেই ম্যাচটায় বাংলাদেশ বিন্দুমাত্র লড়াই করতে পারেনি। কিন্তু ফলাফল ছাপিয়ে ভারতের প্রতি ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। দুইটি বিতর্কিত কল গিয়েছিল ভারতের পক্ষে। রোহিত শর্মার বিপক্ষে রুবেল হোসেনের নো বল ও মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদের ক্যাচ আউট।
এই দুই বিতর্কিত ফলাফলই যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালিয়ে রাখে। আর স্টার স্পোর্টসের সেই বিজ্ঞাপন স্ফুলিঙ্গের সামনে কাগজের টুকরো নিয়ে হাজির হয়। আর সেই আগুনের তীব্রতায় ভষ্ম হয় ভারত। প্রথমবারের মত ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে জয়লাভ করে বাংলাদেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তখন বাংলাদেশিদের উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভেঙে যায়।
ঠিক তারপর ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার হেডলাইনে আবারও খাটো করা হয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের কোন কৌশল নেই, নেই কোন পরিকল্পনা আছে স্রেফ প্রতিশোধের আগুন। সেটাও দুই দেশের সমর্থকদের মনে নেতিবাচকতার সঞ্চার ঘটায়। এই নেতিবাচকতাকে দ্বিগুণ করে বাংলাদেশি এক ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ।
২০১৫ সালের ওয়ানডে সিরিজে বিস্ময়ের জাদুবাক্স খুলে হাজির হয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। তার কাটারের ধূর্ততায় খাবি খেয়েছেন ভারতীয় ব্যাটাররা। রম্য ম্যাগাজিন ‘রসআলো’-এর প্রচ্ছদে অর্ধেক মাথা কামানো ভারতীয় ব্যাটারদের মুন্ডুর সাথে হাতে খুর সমেত দাঁড়িয়ে থাকা মুস্তাফিজের কাটআউট স্থান পায়।
ব্যঙ-কে তখন ভারতীয়রা অপমান হিসেবেই গ্রহণ করে। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে দুই দেশের ক্রিকেট ভক্তদের রেষারেষি পৌঁছে যায় চরমে। এরপর কেউ আর সেই বিদ্বেষের আগুনে পানি ঢেলে দেয়নি। বরং যার যখন মনে হয়েছে খড়কুটো এনে ঢেলেছে, কেউ কেউ তো ঢেলেছে দেশি ঘি। ব্যাস, সমর্থকদের বিরোধের আগুন ক্রিকেট ছাপিয়ে অন্যসব সেক্টরেও ছড়িয়ে পড়ে।
তবে এক্ষেত্রে যে শুধু মিডিয়াই এমন বিদ্বেষ উষ্কে দিয়েছে তা নয়। দুই দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ভূ-রাজনৈতিক নানা জটিলতা ও পারশ্বপারিক অসম বণ্টনও প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। তাইতো ভারত-পাকিস্তানের মাঠের লড়াই ছাপিয়ে এখন বাংলাদেশ-ভারত মাঠের লড়াইয়ে উত্তাপটা টের পাওয়া যায় কয়েকগুণ বেশি।
কিন্তু বিদ্বেষের এই আগ্রাসী দ্বৈরথের শেষ কি কখনো হবে? সৌহার্দ্যপূর্ণ একটা সোশ্যাল মিডিয়া কি আর কখনো ফিরে যাওয়া যাবে? হয়ত যাবে সে ক্ষেত্রে দুই পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে। অসম সকল সুবিধা বর্জন করে একই কাতারে দাঁড়াতে পারলেই হয়ত বিদ্বেষের লেলিহান শিখা নিস্তেজ হবে।