ক্রিকেটে এসেছিলেন তিনি অমিত প্রতিভা নিয়ে, তাঁর মধ্যে ছিল অপার সম্ভাবনা। রাহুল দ্রাবিড়, স্টিভেন স্মিথ, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্সের মত ব্যাটসম্যানের উইকেট যিনি পেয়েছিলেন, এমনকি জানতেন তাঁদের কখন কীভাবে কোন ধরণের ডেলিভারি দিয়ে ভড়কে দেওয়া যাবে – তাঁর প্রতিভা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা না।
একজন ক্রীড়াবিদের পেশাদার ক্যারিয়ার অনেক উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে যায়। ক্রিকেট হোক, কিংবা ফুটবল – সব সেরা তারকাদের জীবনেই এসেছে বাজে সময়। তবে, শান্তাকুমারান শ্রীশান্তের ব্যাপারটা আলাদা। এই গল্পে ফিক্সিং আছে, আছে জেল, আছে এক গাদা অন্ধকার।
একইভাবে তিনি তাঁর দেশের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, যেটা প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন। ভারতের হয়ে ২০১১ সালের বিশ্বকাপ জেতেন শ্রীশান্ত। আর মূদ্রার উল্টোপিঠও আছে। ভক্তরা তো বটেই, সতীর্থরাও তাঁকে ‘অভিনেতা’ বলে ঠাট্টা করতো, তিনি আসলেই সিনেমায় অভিনেতা হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে ক্রিকেটের বাইরেও তার প্রতিভা আছে।
শ্রীশান্তের গল্পে আছে জেল থেকে বেরোনোর পর নিজেকে শেষ করে দেয়ার অভিলাষ, যা তাঁকে একসময় আত্মহত্যার কথা ভাবিয়েছিল। তেমনি এই গল্পে খুঁজে পাওয়া যাবে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ৮ বছর পর ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনেই উইকেট নেয়ার গল্প, যেই স্বপ্ন তিনি নিষেধাজ্ঞায় যাওয়ার পরদিন থেকেই দেখতেন।
খেলা যেটাই হোক, নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিভার পাশাপাশি আরও কিছু গুণাবলি থাকা দরকার ধারাবাহিকতা, পরিশ্রম, দক্ষতা বাড়ানোর সামর্থ্য -এগুলো তাঁর মধ্যে থাকে। সব ক্রীড়াবিদরাই পরিশ্রমী হন, চেষ্টা করে যান নিজের স্কিল ডেভেলপ করার। তবে একজন ক্রিকেটার এবং গ্রেটনেস এর মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় ‘ধারাবাহিকতা’।
শ্রীশান্তর পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ছিল ধারাবাহিকতার অভাব। বল এর সিম পজিশন কিংবা ব্যাটসম্যান এর দিকে দেয়া আগ্রাসী লুক-একজন আদর্শ পেসারের অ্যাটিটিউড ঠিক যেমনটা হওয়া দরকার শ্রীশান্তের মধ্যে সেটা সব সময় লক্ষ্য করা গিয়েছে। হেয়ারব্যান্ড পড়া শ্রীশান্ত যখন বোলিং এর জন্য দৌড় শুরু করতেন তখন তার অগোছালো চুল বাতাসে দোলা খেয়ে সেই আগ্রাসী লুকের ষোলকলা পূর্ণ করতো। তবে বলের লাইন এবং লেন্থ যেন অধিকাংশ সময়েই তাঁর মনের কথা শুনতো না- এমন অধারাবাহিকতার সাথেই শ্রীশান্ত ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন।
তবে নিজের দিনে শ্রীশান্ত ছিলেন সেরাদের একজন। এই অধারাবাহিক ক্যারিয়ারেও শ্রীশান্তের এমন সব ম্যাচ, এমন সব ইনিংস আছে যেগুলোর হাইলাইটস এই জেনারেশনের কাউকে দেখালে হয়তো ভাববে যে এই বোলার নিশ্চয়ই টেস্টে ৪০০ উইকেট পাওয়া বোলার ৷ তবে ২৭ টেস্ট খেলে ৩৭.৫৯ গড়ে তার উইকেট সংখ্যা মাত্র ৮৭ টি, যে পরিসংখ্যান খুবই গড়পড়তা মানের। যে পরিসংখ্যান তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেয় না, বরং অধারাবাহিকতার প্রতিফলন দেখায়।
শ্রীশান্ত ক্যারিয়ার এর শুরুটা করেছিলেন লেগ স্পিনার হিসেবে, তাঁর রোল মডেল এবং আদর্শ ছিলেন স্বয়ং অনিল কুম্বলে। তবে ইয়র্কার করার প্রবণতার কারণে তিনি পেস বোলার হয়ে যান ও ২০০০ সালে চেন্নাইয়ের এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে নির্বাচিত হন। সেখান থেকে এরপর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, ভারতীয় বি দল এবং এ দলে ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে তাঁর জায়গা মেলে জাতীয় দলে, সুযোগ মেলে নীল জার্সি পড়ে জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করার।
শ্রীলংকার বিপক্ষে ২০০৫ সালে ওয়ানডে অভিষেকের মাধ্যমে শ্রীশান্তের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এর সূচনা হয়। সেদিন শুরুটা সনাথ জয়াসুরিয়া এবং কুমার সাঙ্গাকারার হাতে বিস্তর রান হজম করার মাধ্যমে হলেও সেই ম্যাচেই ২ উইকেট তুলে নেন তিনি। তবে তার ক্যারিয়ার এর টার্নিং পয়েন্ট ছিল পাকিস্তান সিরিজটা, যে সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে তিনি চার উইকেট তুলে নেন এবং পরের ইংল্যান্ড সিরিজে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়, যেখানে প্রথম ম্যাচেই চার উইকেট তুলে নেন তিনি। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম আইকনিক সিরিজ ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২০০৬ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজ, যেখানে তিনি ১৬ গড়ে ১০ উইকেট তুলে সিরিজ সেরা হন। ফলে পেয়ে যান বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে ঠাই পেয়ে যান।
শ্রীশান্তের টেস্ট ক্যারিয়ার এর শুরুটা যতোটা ভালভাবে হয়েছিল ওভাবেই পরের সিরিজগুলোতে শ্রীশান্ত পারফর্ম করেছিলেন। নিজের ক্যারিয়ার এর ওই অংশটুকুতেই সম্ভবত শ্রীশান্ত সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিক হতে পেরেছিলেন। ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট সিরিজের পর জায়গা পান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও। ইরফান পাঠান দলে না থাকায় সেবার তাঁকে পেস আক্রমণের দায়িত্ব নিতে হয়। ইনজুরির কারণে শ্রীশান্ত দ্বিতীয় ম্যাচ মিস করলেও চতুর্থ ম্যাচে ফিরে ৭২ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৫ উইকেট, যা তার টেস্ট ক্যারিয়ার এর অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।
ব্যক্তিগত ভাবে শ্রীশান্তের জীবনের সবচেয়ে সেরা সিরিজ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে খেলা টেস্ট সিরিজ। সেবার ওয়ানডে সিরিজ হারাতে এমনিতেই চাপের মুখে ছিল টিম ইন্ডিয়া। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে প্রথম টেস্টে শ্রীশান্তের ৪০ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট পাওয়ার বোলিং ফিগারই ভারতকে এনে দেয় প্রথম টেস্টে জয়, যা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভারতের প্রথম টেস্ট জয় ছিল।
শ্রীশান্ত যখন ছন্দে থাকতেন, তখন তিনি নি:সন্দেহে সেরাদের একজনের মত বোলিং করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে জ্যাক ক্যালিসকে করা সেই বাউন্সারটাই দেখে আসুন। এমন আনপ্লেয়েবল বাউন্সার যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই দু:স্বপ্ন, জ্যাক ক্যালিসের মতো গ্রেট ব্যাটসম্যানও যা সামলাতে পারেননি। তবে তিনি তার সেরাটা কখনোই ম্যাচের পর ম্যাচ একদম ধারাবাহিকভাবে দেখিয়ে যেতে পারেননি, এজন্য ভারতীয় দলে কখনও পুরোপুরি নিয়মিত সদস্য হতে পারেননি।
এত প্রতিভাবান এবং সম্ভাবনাময় উদীয়মান একজন বোলার হওয়ার পরেও শ্রীশান্তের ধারাবাহিক না হওয়ার পেছনে শ্রীশান্তের ব্যক্তিগত জীবনের বড় ভূমিকা আছে। শ্রীশান্ত বড্ড আবেগী ছিলেন, ভারতীয় জাতীয় দলে আসার পর আশা করেছিলেন পারফর্ম করে সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন,স্পটলাইটে থাকবেন। কিন্তু কখনোই তা তিনি পাননি। তাছাড়া শ্রীশান্তের নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল একাকীত্ব।
সতীর্থদের সাথে একই ড্রেসিং রুম শেয়ার করলেও পার্সোনালি কারও সাথেই তাঁর তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১১ সালে ইশান্ত শর্মার এক সাক্ষাৎকারে, সেখানে সদ্য জাতীয় দলে ঢোকা তরুণ পেসার ইশান্ত শর্মা বলেন, ‘সত্যি বলতে আমি আমার সতীর্থদের মধ্যে একমাত্র শ্রীশান্তকেই খুব একটা চিনি না। আসলে ও ভাবে কারও সাথে আলাপ করে না। সব সময় একা থাকতে পছন্দ করে। মনে হয় যেন ও ওর নিজের দুনিয়াতে ডুবে আছে।’
শ্রীশান্তের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধু অজয় শঙ্কর বলেন, ‘আমি অনেক তাড়াতাড়ি বুঝে যাই যে শ্রীশান্ত অনেক একাকী একজন ক্রিকেটার, ভারতীয় দলে এমন কেউ নেই যাকে শ্রীশান্ত নিজের বন্ধু বলতে পারবে। শ্রীশান্ত সব সময় বলত যে ভারতীয় দলে তাঁর কোনো বন্ধু নাই, তার পেছনে কোনো গডফাদার নেই তাই কেউ তাঁকে পছন্দ করে না। এমনকি শ্রীশান্ত কে নিয়ে তার কিছু সতীর্থ গুজব ছড়াতো যে সে নাকি সব সময় তার সাথে ছুড়ি নিয়ে ঘুরতো।’
মাঠের বাইরে নিজের এই আবেগ অনেক সময় মাঠের মধ্যেও তিনি সামলাতে পারতেন না। যে দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট সিরিজে শ্রীশান্ত পারফরম্যান্সের জন্য খ্যাতির কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিলেন, সেই একই সিরিজে শ্রীশান্ত সমালোচিত হয়েছিলেন তাঁর অন দ্য ফিল্ড আচরণের কারণে। হাশিম আমলাকে আউট করার পর করা অঙ্গভঙ্গির কারণে তাকে ম্যাচ ফি’র ৩০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়েছিল।
এমনকি ওই সিরিজের এক ম্যাচে ব্যাটিং করার সময় আন্দ্রে নেইলের এক বাউন্সারের জবাব দিয়ে পরের বলে ছক্কা হাঁকান শ্রীশান্ত। এরপর আন্দ্রে নেইলের নাচ অনুকরণ করে তাঁকে বিদ্রুপ করেন। সেটাও ঐ সময়ে অনেক বেশি সমালোচিত হয়েছিল। শ্রীশান্তের অন দ্য ফিল্ড আবেগ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। ইংল্যান্ড সফরে বেশ কয়েকবারই তিনি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছিলেন।
ওই সিরিজে তৎকালীন ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভনকে অকারণে ঘাড় ধাক্কা দেয়ার জন্য তাঁকে জরিমানা গুণতে হয়। তাছাড়া ওই সিরিজে কেভিন পিটারসেনকে করা মাথা বরাবর করা একটি ফুল টস বল এবং পল কলিংউডকে করা একটি দৃষ্টিকটু বাউন্সার করার কারণে অনেক ইংলিশ সাবেক ক্রিকেটার তাকে তুমুল সমালোচনা করেন, অনেকে দাবি করেন যে তাঁর এসব কর্মকাণ্ড গেম এর স্পিরিটকে নষ্ট করে, যার জন্য তাঁকে নিষিদ্ধ করা উচিৎ।
এসবের মধ্য দিয়েই শ্রীশান্তের ক্যারিয়ার পার হয়ে যাচ্ছিল। জাতীয় দলে শ্রীশান্ত আশা যাওয়ার মধ্যেই থাকতেন। ২০০৬ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শ্রীশান্ত প্রাথমিকভাবে জায়গা না পেলেও অজিত আগারকারের ইনজুরি তাঁকে জায়গা করে দেয়। শ্রীশান্ত জায়গা পান ভারতের ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলেও, যেবার ভারত বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। যদিও ওই টুনার্মেন্টে শ্রীশান্তের পারফরম্যান্সে অধারাবাহিকতা ছাপ ছিল, তবে সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে তাঁর পারফরম্যান্স ক্রিকেট ভক্তদের মনে অনেকদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অধারাবাহিক প্রতিভা শ্রীশান্ত যে নিজের দিনে আসলেই সেরা তার প্রমাণ তিনি ঐ ম্যাচে গিলক্রিস্ট এবং ম্যাথিউ হেইডেনকে আউট করে দেন, যে দুই উইকেটই ওইদিন ভারতকে জয় এনে দেয়। ১২ রান দিয়ে ২ উইকেট নেয়া শ্রীশান্তের সেই বোলিং ফিগারটা ঐ টুনার্মেন্টের অন্যতম সেরা বোলিং ফিগার হিসাবে তখন বিবেচনা করা হয়েছিল। তাছাড়া ফাইনালে মিসবাহ উল হকের ক্যাচ নিয়ে ম্যাচটাও শ্রীশান্ত জিতিয়েছিলেন।
২০০৭ সালের শ্রীশান্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য দলের বাইরে ছিলেন। দেড় বছর পর ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সাথে টেস্ট সিরিজ দিয়ে জাতীয় দলে ফেরেন শ্রীশান্ত, ওই সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে জয় এনে দেন শ্রীশান্ত পাশাপাশি ম্যাচ সেরাও হন। ওই ম্যাচের পরই অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনির মনে জায়গা করে নেন শ্রীশান্ত যাকে ধোনি কিনা রিভার্স সুইং বোলিংয়ের জন্য ‘বিশ্বের অন্যতম সেরা’ বোলার বলে আখ্যায়িত করেন।
২০১১ বিশ্বকাপের আগে প্রবীন কুমার ইনজুরিতে পড়ায় তাঁর জায়গায় স্কোয়াডে ডাক পান শ্রীশান্ত। ঐ বিশ্বকাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার সাথে একাদশে জায়গা পান তিনি,তবে সেদিন খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। অনেক রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি। অবশ্য ঐদিন সে ধোনির কারণেই একাদশে সুযোগ পান এবং ধোনি পরে নিজেও ভুলটা স্বীকার করে নেন।
শ্রীশান্তের ক্যারিয়ার এর এমন চড়াই উৎরাইয়ের পেছনে অনেকে তাঁর মেন্টর বা দিকনির্দেশক হিসেবে কেউ না থাকাটাকে দায়ী করেন। অনেকে মনে করেন,অধারাবাহিক এই ক্যারিয়ার এ একমাত্র রাহুল দ্রাবিড়ের অধীনেই শ্রীশান্ত নিজের সম্ভাবনা ও প্রতিভার অনেকটুকু দেখাতে পেরেছিলেন।
২০১৩ সালে আইপিএলের স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি শ্রীশান্তের পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানতে বাধ্য করে। মজার বিষয় হল সেবারও রাহুল দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্বেই শ্রীশান্ত রাজস্থান রয়্যালসে খেলছিলেন।
স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে জেলে যেতে হয়েছে শ্রীশান্তকে, পেয়েছিলেন ক্রিকেট থেকে আজীবনের নিষেধাজ্ঞা। যদিও আবেদর করে সেই নিষেধাজ্ঞা আট বছরে কমে আসে, তবে শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেটে সেটাকেই শ্রীশান্তের বিদায় বলা যায়।
ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার প্রথম দিকটা শ্রীশান্ত মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। নিজেই জানিয়েছিলেন যে, ওই আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। তবে শ্রীশান্ত সেখান থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞার এই সময়টা শ্রীশান্ত বিভিন্ন টেলিভিশন রিয়েলিটি শো-তে অংশ নেন, সিনেমায় কাজ-টাজ করেন।
এত চড়াই উৎরাইয়ের পরও শ্রীশান্তের স্বপ্ন ছিল যে আবার একদিন ক্রিকেটের মাঠে ফিরবেন। ২০২০ সালে তার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে কেরালা দলের হয়ে মাঠে নামেন। প্রত্যাবর্তনের ম্যাচেই শ্রীশান্ত উইকেট তুলে নিয়ে প্রমাণ করেন যে যত যাই হোক, এই ক্রিকেটকে তিনি বড্ড বেশিই ভালোবাসেন আজও। তবে, এই বয়সে সেই ভালবাসা চালিয়ে যাওয়াটা তো সহজ নয়। তাই, ২০২২ সালের মার্চে সব কিছুর ইতি টানেন।
দিনটা ছিল নয় মার্চ। শ্রীশান্ত বলেন, ‘মাঝে মধ্যে আমি ভাবি আমার ক্যারিয়ারে যা হয়েছে ভালোর জন্য হয়েছে। স্বাভাবিক ক্যারিয়ার হলে আমি অবসরের পর দুবাই বা ইংল্যান্ডে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতাম হয়তো, কিন্তু আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসত না। তবে, আমি এখন গর্বের সাথে বলতে পারি আমার নিজের মন এবং চিন্তাভাবনার উপর আমার নিজের নিয়ন্ত্রন আছে। আমি এখন সব সময় চেষ্ট করি ইতিবাচক চিন্তা করার। যদি কেউ কোনো কারণে হতাশ থাকে তাহলে আমি তাদের বলতে চাই, আমি শ্রীশান্ত এতকিছুর পর যখন আবারও ফিরতে পেরেছি, তুমিও পারবে। আমি সব মানুষের জন্য একজন অনুপ্রেরণা হতে চাই।’
সামান্য এই কথাটাতেই যেন পুরো ক্যারিয়ারের আবেগ-অনুভূতি, উত্থান-পতনের গল্প বলা হয়ে গেল শ্রীশান্তের।
শ্রীশান্তের কখনোই নিজের প্রতিভা এবং সম্ভাবনা অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম না করতে পারার আক্ষেপ হয়তো ২০০৫ থেকে ২০১১ এর মধ্যে ক্রিকেট দেখা সকল ভারতীয় ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকের মাঝে থাকবে। তবে ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে যোগিন্দার শর্মার বল মিসবাহ উল হক হাওয়ায় ভাসানোর পর ‘ইন দ্য এয়ার অ্যান্ড শ্রীশান্ত টেকস ইট’ – এই ধারাভাষ্য, এই মুহূর্তের জন্যই প্রজন্মের পর প্রজন্ম শ্রীশান্ত ভারতসহ ক্রিকেট ভক্তদের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। চাইলেই তো কত কিছুই ভোলা যায়, কিন্তু ইতিহাস ভোলা যায় না!