লিভারপুলের দু:স্বপ্নের মৌসুম, আড়ালের গল্প

কিন্তু এবারের মৌসুমে যেন এক ধাক্কায় আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়েছে অলরেডরা। ইনজুরি, বাজে ট্রান্সফার উইন্ডো আর মাঠের বাইরের অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছে দলের খেলাতে। ফেবারিট হিসেবে লিগ শুরু করলেও শিরোপা স্বপ্ন একপ্রকার শেষ ক্লপের শিষ্যদের জন্য।

লিভারপুলে আসার পর থেকেই স্বপ্নের মতো কাটাচ্ছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতিয়েছেন, তিন যুগ পর এনে দিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা।

কিন্তু এবারের মৌসুমে যেন এক ধাক্কায় আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়েছে অলরেডরা। ইনজুরি, বাজে ট্রান্সফার উইন্ডো আর মাঠের বাইরের অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছে দলের খেলাতে। ফেবারিট হিসেবে লিগ শুরু করলেও শিরোপা স্বপ্ন একপ্রকার শেষ ক্লপের শিষ্যদের জন্য। আসুন দেখে নেয়া যাক এবারের মৌসুমে লিভারপুলের দুর্দশার কারণ।

  • মৌসুমের শুরুতেই ধাক্কা

সবকিছুর শুরুটা হয়েছিল ক্রাভেন কটেজে। কমিউনিটি শিল্ড জয়ের ছয়দিন পরেই সদ্য প্রিমিয়ার লিগে উত্তীর্ণ হওয়া ফুলহামের মুখোমুখি হয় লিভারপুল।

ক্লপ তাঁর সেরা একাদশটাই মাঠে নামিয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের একাদশ থেকে ছিলেন না কেবল ইব্রাহিমা কোনাটে এবং বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেয়া সাদিও মানে। তাঁদের বদলে একাদশে ঢুকেন জোয়েল মাতিপ এবং রবার্তো ফিরমিনো। বেনফিকা থেকে ৭৫ মিলিয়নে যোগ দেয়া ডারউইন নুনেজ শুরু করেন বেঞ্চে থেকেই। 

কিন্তু লিভারপুলের বেঞ্চের বাকি ফুটবলারদের দিকে তাকালেই বেরিয়ে পড়ে দলের কংকালসার দশা। সেপ ভ্যান ডার বার্গ, লুক চ্যাম্বার্স, স্টেফান ব্যাজেটিচ – কারোরই প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক ঘটেনি। ইনজুরি রীতিমতো আড়েপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছিল লিভারপুলের ফুটবলারদের। 

দিয়েগো জোটা এবং অক্সালেড চ্যাম্বারলিন হ্যামস্ট্রিংয়ের সমস্যায় ভুগছিলেন প্রি সিজন টুর্নামেন্ট থেকেই। দলে নতুন আসা ক্যালভিন রামসে পিঠের ব্যথায় অনিশ্চিত। কমিউনিটি শিল্ডে গোল করা কার্টিস জোনসও ভুগছিলেন একই সমস্যায়। তাঁদের কেউই অক্টোবরের আগে মাঠে ফিরতে পারেননি। সেন্টারব্যাক ইব্রাহিমা কোনাটে তো লিগামেন্ট ছিঁড়ে ছিটকে যান ছয় মাসের জন্য। 

ম্যাচের মাঝেই ইনজুরির শিকার হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছাড়েন থিয়াগো আলকান্তারা। তাঁর প্রস্থানের পরই যেন ফাঁকফোকর বেরিয়ে পড়ে অলরেড মিডফিল্ডের। 

ম্যাচে ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর নুনেজ এবং সালাহর গোলে কোনোমতে ড্র নিয়ে ফেরে ক্লপের শিষ্যরা। 

  • নুনেজের লালকার্ড এবং ভঙ্গুর মিডফিল্ড

ঘরের মাঠে মৌসুমের প্রথম ম্যাচে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে ম্যাচে ইনজুরি লিস্ট আরো লম্বা হয় লিভারপুলের। মাতিপ  এবং ফিরমিনো দুজনেই ইনজুরিতে ছিটকে যান দীর্ঘ সময়ের জন্য। ইনজুরি থাকা সত্ত্বেও জর্ডান হেন্ডারসন এবং জো গোমেজকে বেঞ্চে রাখতে বাধ্য হন ক্লপ। 

দুই সেন্টারব্যাকের ইনজুরিতে ভ্যান ডাইকের সাথে জুটি বাঁধেন ন্যাট ফিলিপ্স। যিনি কিনা আগের মৌসুমের অর্ধেকটা বোর্নমাউথে লোনে কাটিয়েছেন এবং নতুন মৌসুমে দল ত্যাগের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। ম্যাচের শুরুতেই ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়া লিভারপুলের বিপদ আরো বাড়ে যখন লাল কার্ডে মাঠ থেকে বেরিয়ে যান নুনেজ। 

লুইস দিয়াজের একক দক্ষতায় সেদিন এক পয়েন্ট পেয়েছিল লিভারপুল। কিন্তু শুরুতেই দুর্বল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হোঁচট, বিশাল ইনজুরি লিস্ট, তারকা ফুটবলারদের অফফর্ম এবং তাঁদের বিগমানি সাইনিংয়ের তিন ম্যাচের ব্যান দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল কোচ এবং সমর্থকদের মনে। 

তখনো পর্যন্ত লিভারপুল নুনেজ, রামসে, ফাবিও কারভালহোদের ভিড়িয়ে সফল এক ট্রান্সফার উইন্ডো পার করছে এমনটাই ধরে নিয়েছিল। মিডফিল্ডে নতুন মুখ না এনে বরং সালাহর সাথে ক্লাব ইতিহাসের সর্বোচ্চ বেতনের চুক্তি সেরেছে। এরপর সময় যত গড়িয়েছে নতুন মিডফিল্ডার না ভেড়ানোর আক্ষেপ তত বেড়েছে ক্লপের। 

তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল জুড বেলিংহাম এবং অরেলিয়ের শুয়ামেনির দিকে। প্রথমজনের ক্লাব বরুশিয়া পরিষ্কার জানিয়ে দেয় এই মৌসুমে ছাড়ছে না ইংরেজ তরুণকে। অন্যদিকে শুয়ামেনির শয়নে স্বপনে কেবলই রিয়াল মাদ্রিদ। ফলে লিভারপুল সিদ্ধান্ত নেয় সিনিয়র মিডফিল্ডারদের নিয়েই এই মৌসুম কাটানোর যারা কিনা বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং ফর্মে ফিরতে যুঝছেন। 

লিভারপুল তাঁদের ভুলটা বুঝতে পারে ট্রান্সফার উইন্ডোর একদম শেষদিনে এসে। তাঁদের দলে ভেড়ানো ফুটবলারের নামটাও কুড়িয়েছে বিস্ময়। জুভেন্টাস থেকে ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে লোনে ভেড়ায় আর্থুর মেলোকে। তিনি আগে থেকেই ইনজুরিতে ছিলেন, মৌসুমের ছয় মাস কেটে গেলেও এখনো ফুল ফিট হতে পারেননি। লিভারপুলের হয়ে মাঠে ছিলেন মোটে ১৩ মিনিট। 

  • ট্যাকটিকসে ভুল

এবারের মৌসুমের প্রতিটা ম্যাচেই লিভারপুল শুরুটা করেছে দুর্দান্ত। সময় যত গড়িয়েছে তাঁদের খেলার ধার তত কমেছে। গেগেনপ্রেসিংয়ের সাথে তাল মেলাতে পারেননি ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড এবং জো গোমেজের মতো পুরনো ফুটবলাররাও। বেশিরভাগ ম্যাচেই তুলে ফেলতে হয়েছে প্রথমার্ধের পরেই।

কুইন এলিজাবেথের মৃত্যু এবং আর্ন্তজাতিক বিরতির পর প্রথম ম্যাচেই ব্রাইটনের সাথে ৩-৩ গোলে ড্র করার পর ক্লপ সিদ্ধান্ত নেন ট্যাকটিকসে পরিবর্তন করার। ৪-৩-৩ ফর্মেশন থেকে সরে এসে ক্লপ দুই ফরোয়ার্ড খেলানো শুরু করেন ৪-৪-২ ফর্মেশনে। নতুন স্টাইলে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রেঞ্জার্সের বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতলেও আর্সেনালের বিপক্ষে হেরে যায় ৩-২ গোলে। 

এরপরের নয় ম্যাচে মোটামুটি ভালোই খেলেছে অলরেডরা, নয় ম্যাচে তুলে নিয়েছিল সাত জয়। কিন্তু দিয়েগো জোতা এবং লুইজ দিয়াজ বড় সময়ের জন্য মাঠের বাইরে চলে গেলে অকার্যকর হয়ে পড়ে ক্লপের নতুন ট্যাকটিকস। 

  • বিবর্ণ পরিসংখ্যান

লিভারপুলের দুরবস্থার কারণ খুঁজতে দূরে যেতে হবে না, পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ এবারের লিগে ইতোমধ্যেই তাঁরা যত পয়েন্ট হারিয়েছে, সেটা গতবারের পুরো মৌসুমের চাইতেও বেশি। অ্যাওয়ে ম্যাচে তো লিভারপুলের পারফরম্যান্স আরো বিবর্ণ, আট ম্যাচে জয়ে পেয়েছে মোটে দুই ম্যাচে।

ম্যাচের শুরুতেই নিজেদের কাজটা কঠিন করে ফেলেছে অলরেডরা। মোট ১৪ বার তাঁরা শুরুতে গোল হজম করেছে এবং মাত্র পাঁচ বারই সেখান থেকে জয় কিংবা ড্র নিয়ে ফিরতে পেরেছে। 

লিভারপুলের শক্তিশালী ডিফেন্সও এবার খানিকটা মলিন। অ্যালিসন-ভ্যান ডাইকের মতো ফুটবলার থাকা সত্ত্বেও ২৭ ম্যাচে ক্লিনশিট রাখতে পেরেছে মোটে আট ম্যাচে। 

দলের অভিজ্ঞ ফুটবলাররাও ফর্মে ফিরতে হিমশিম খাচ্ছেন। ভ্যান ডাইক, থিয়াগো, ফ্যাবিনহোরা নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ১৭ গোল করলেও লিগে সালাহর গোলসংখ্যা মাত্র সাতটি। গতবার লিগের এই পর্যায়ে সালাহর গোলসংখ্যা ছিল ১৬টি। 

দলে নতুন আসা ডারউইন নুনেজ ছিলেন মন্দের ভালো। মাঝের অফফর্ম কাটিয়ে উলভসের বিপক্ষে গোল করে দুই অংকের ঘরে প্রবেশ করেছেন। জানুয়ারিতে নতুন যোগ দেয়া বিশ্বকাপ তারকা কোডি গাকপো এখনো দলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি। তাঁদের সাথে ইনজুরিতে থাকা জোতা এবং দিয়াজ ফিরলে আক্রমণভাগ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে ক্লপের। তবে প্রশ্নটা হলো ইতোমধ্যেই খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে কিনা।

  • মাঠের বাইরের অস্থিরতা

কেবল মাঠের পারফরম্যান্স নয়, মাঠের বাইরেও লিভারপুল পার করছে অস্থির সময়। মৌসুমের শুরুতেই দীর্ঘদিনের ক্লাব ডাক্তার জিম মক্সন অ্যানফিল্ড ছেড়েছেন। শোনা যাচ্ছে মৌসুম শেষেই বিদায় নেবেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর জুলিয়ান ওয়ার্ডও। এছাড়া গুঞ্জন আছে ক্লাবের মালিকপক্ষও কিছু শেয়ার বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছেন। 

আমেরিকান গ্রুপ ফেনওয়ে স্পোর্টস গত এক দশক ধরে লিভারপুল নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্লাবটির পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে দারুণ কাজ দেখিয়েছে তাঁরা। কিন্তু চিন্তার কথা হলো কতদিন তাঁরা অর্থনৈতিক স্বাছন্দ্য বজায় রাখতে পারবে। প্রিমিয়ার লিগে এমনিতেই অর্থের ঝনঝনানি। ম্যানচেস্টার সিটি, ইউনাইটেড, টড বোহেলির চেলসি তো আছেই, নতুন যুক্ত হয়েছে সৌদি আরবের মদদপুষ্ট নিউক্যাসল। সুতরাং লিভারপুলের সামনে তাই অপেক্ষা করছে কঠিন সময়। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...