বাদশাহর সোনালী সাম্রাজ্য

ইতিহাসের একজন চিরস্থায়ী পেসার হওয়ার মানদণ্ড কি, পরিসংখ্যান? হতে পারে! তাই বলে পরিসংখ্যানে কি আর সবকিছু পাওয়া যায়! হয়তো না।

ইতিহাসের একজন চিরস্থায়ী পেসার হওয়ার মানদণ্ড কি, পরিসংখ্যান? হতে পারে! তাই বলে পরিসংখ্যানে কি আর সবকিছু পাওয়া যায়! হয়তো না।

পেস বোলাররা সাধারণত দুই ধরনের হয়। এক, পেস এবং বাউন্স দিয়ে আপনাকে নাজেহাল করবে এবং দুই, সুইং এবং লাইন-লেংথ দিয়ে আপনাকে নাকাল করে দিবে। দুই ধরনের বল দেখতেই আনন্দ আছে তবে সুইং এর যে জাদু আছে তা আপনাকে টিভির সামনে বসে থাকতে বাধ্য করবে। এই সুইং স্পেশালিস্ট বোলাররা খুব একটা গতিসম্পন্ন হয় না তবে অফস্টাম্প থেকে আউটসুইং কিংবা ইনসুইং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বারোটা বাজিয়ে দিবেন এটা সত্য!

মনে করুন কোন এক টেস্ট ম্যাচ খেলতে মাঠে নামলেন। টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন; প্রতিপক্ষ সাড়ে তিনশো রানের বোঝা চাপিয়ে দিলো আপনার মাথায়। কন্ডিশন অনুযায়ী খুব একটা সুইং ছিল না পিচে। কিন্তু রসিক আবহাওয়াও যে সেদিন আপনার বিপক্ষে! আপনার ইনিংস শুরুর আগে আগে আকাশে হালকা মেঘের ঘনঘটা। আপনার নিজের মাঠ-ই শুরু করে দিলো আপনার বিরুদ্ধাচারণ; প্রথম ওভারটা কাটিয়ে দিলেন কোনো রকম।

দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে আসলেন সুইং স্পেশালিষ্ট বোলার। স্পেলের দ্বিতীয় বল, বল মিডল স্টাম্পে পড়ে খানিকটা লেট সুইং খেয়ে অফ স্টাম্প উড়ে গেলো। আহ! কি সুন্দর সেই দৃশ্য! আপনি ভুক্তভোগী হলে অবশ্য তা ভালো লাগার কথা না! ওয়ান-ডাউনে নামলেন আপনার দলের সেরা ব্যাটসম্যান। কয়েকটি বল খেলার পর তাঁরও পরিণতি এক। কিন্তু এবারেরটা আরো বেশি সুন্দর। একই রকম বাঁক বলের কিন্তু পেসের পরিমাণটা হালকা বেশি! এবারো অফ-স্টাম্প নেই! ব্যাটসম্যানশিপ ছেড়ে রেখে বোলিং দেখুন; আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য হবেন নিশ্চয়ই!

ফ্যান্টাসি ছেড়ে টপিকে আসা যাক; লেখার শুরুতেই সহজ কিন্তু দুর্বোধ্য একটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি। ‘বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা পেস বোলার কে? মাশরাফি?’ বেশ তর্কসাপেক্ষ প্রশ্ন হলেও সত্য যে, গোলাম নওশের প্রিন্স, আতাহার আলী খান, গোলাম ফারুক সুরু, রফিকুল আলম, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ থেকে শুরু করে মাশরাফি, তালহা জুবায়ের, নাজমুল হোসাইন বা হালের রুবেল- মুস্তাফিজ সবাই-ই পেস বোলিংয়ে বাংলাদেশে একেককজন মহীরুহের নাম। তবে উনাদের মধ্যে সেরা বাছাইয়ে গেলে কেমন হয়! উত্তরটা না’হয় খানিক পরেই দিই! তার আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মুকুট হীন এক রাজার গল্প শুনে আসি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭০ এর দশকে ক্রিকেট খুব কমই জনপ্রিয় খেলা ছিল। মূলত আর্থিক দিক থেকে ধনাঢ্য সম্প্রদায়ের কয়েকজনই এই খেলাধুলা চালিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা। সেই সময়কালে অন্য অনেকের মতো পেশাদার ক্রিকেট এবং ফুটবল উভয়ের সাথেই জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফুটবলার হিসাবে তাঁর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত দেখে তখনকার অনেক বড় বড় নামজাদা ক্লাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে সালে আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে বিমানের হয়ে শিরোপা জয় সেই সময়ে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অর্জন ছিল।

তবে ১৯৭৪ সালে হাঁটুর চোটের পরে বাদশাহর ফুটবলের শেষের শুরু হয়। রাশিয়ান ক্লাবের বিপক্ষে ঢাকা একাদশের হয়ে খেলাকালীন বাদশাহ ইনজুরিতে পড়েন। এটি তাকে ক্রিকেট খেলার প্রতি পুরো মনোযোগ জোর করতে বাধ্য করে। সেই সময়ে বাংলাদেশ সম্ভবত কোনও সম্ভাবনাময় ফুটবলারের কাছে হেরে যেতে পারে তবে ক্রিকেটের জন্য বিষয়টি যতটা সম্ভব স্বস্থির ছিলো। ঠিক সেই সময়ে-ই যে ইতিহাসের সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডার কে স্বাগত জানাতে চলেছে বাংলাদেশ।

১৯৭৭-১৯৭৮ সালের শীতের পর আবারো বাংলাদেশে খেলতে এসেছিল এমসিসি। বাংলাদেশ তখনো কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেনি। সেটা ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরের কথা। ট্যুর চলে ৭৯-এর মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত। অধিনায়ক টেড ক্লার্ক ও অ্যালান রবার্ট ডাফের ফিরতি সফরের সাথে বেশ কিছু উঁচু লম্বা ফাস্ট বোলার লম্বা রান-আপে বল করে বাঙালিদের প্রথমবারের মত ফাস্ট বোলিংয়ের ব্যপ্তি বুঝিয়ে দেন। এ যাত্রা বাঙালিও কম যায়নি। জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ’র ইন সুইং ও ইয়র্কারে হাততালি/হর্ষধ্বনি দেওয়ার মত সুযোগ পায় তারা। বাদশাহ, নাদির শাহ’র বড় ভাই। তবে নাদিরের মত সাদামাটা নয় বেশ ভারিক্কি খেলোয়াড় ছিলেন। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংও ভাল করতেন। ৬/৭ নং স্লটে ব্যাটিং করতেন তিনি।

ম্যাচে তিনি প্রথম দিকের দু/তিনটা উইকেট নিয়েছেন এমনকি তা লাঞ্চের আগেই। এমসিসির আগের সফর গুলোয় আমাদের খুব ভালো যায়নি। কিন্তু না, সেবারের ম্যাচগুলো ড্রই হয়েছিলো কারণ রকিবুল নির্ভর টপ ব্যাটিং অর্ডার ফেল মারলেও সৈয়দ আশরাফুল হক, ইউসুফ বাবু, উইকেটরক্ষক শফিকুল হক হিরা এবং মজিবুল হক মন্টু ভাল ব্যাট চালাতেন।

বাদশা ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং ১৯৯০ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত তাঁকে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তিনি তার মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে সুইংয়ের পসরা সাজিয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলতে সক্ষম ছিলেন। ডানহাতি এই মানুষটি যে কোনও সময় যে কোনও জায়গায় ব্যাট করতে পারার বহুরূপী প্রতিভার অধিকারীও ছিলেন – সেটি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে হোক, নাইটওয়াচম্যান বা ওপেনার হিসাবেই হোক।

ব্যাটিংয়ের চেয়েও তাঁর বোলিং দেখতে দর্শকরা মাঠে আসা শুরু করেন। বলের ওপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ, লাইন-লেংথের সাথে সুইং! তাঁর বোলিং এতোটাই নিখুঁত ছিলো যে দর্শকদের সাথে বিপক্ষ দলের অধিনায়ক পর্যন্ত জয়-পরাজয় একপাশে রেখে বহুবার বাদশাহ’র বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়েছেন। ভাগ্যিস তখনকার দিনে ক্রিকেটারদের কোন ভিডিও ছিলো না, পেশাদার কোন স্পোর্টস ফটোগ্রাফার ছিলোনা যারা ছবি তুলে সংগ্রহশালায় জমে করে রাখবে। ক্রিকেটারদের শেখার জায়গাটায় অনেক সীমাবদ্ধতা ছিলো। কোচদের মুখে মুখে শুনে যতটুকু শিখেছেন তার পুরোটাই ঢেলে দিয়েছেন মাঠে।

ইউসুফ বাবু ও জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ

বাদশাহ জেনুইন ফাস্ট বোলার ছিলেন না। মরা পিচে গতির ঝড় তুলতেন না তিনি। অ্যাটলিস্ট এই মরা উইকেটে গতির ঝড় তোলার ইচ্ছেও উনার ছিলো না। হ্যাঁ, ইংল্যান্ডে অনেক জোরে বল করেছিলেন তিনি। ৮৬’র আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের সেরা পেসার ছিলেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। প্রতিপক্ষ দলের টপঅর্ডারে কাঁপুনি ধরানো বোলিং করেছিলেন সে বছর।

আশির দশকে ফিরে আসা যাক; তখনকার সময়ে খেলোয়াড় আর মাঠ অফিশালদের বয়সের ব্যবধান এতোই কাছাকাছি ছিলো যে মাঠে একে অপরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। সে-সময়ে একটা ম্যাচে আম্পায়ার একই ওভারে বাদশাহ’র বলে দু’টি নো বল দেন। এতে বোলার বাদশাহ খুব বিরক্ত হয়েছিলেন এবং আম্পায়ারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কোনও নো বল করি না; অনুশীলন সেশনের সময় বা এমনকি আমি অন্ধ-ভাঁজ হয়ে থাকলেও।’

সেদিন আর তাঁর চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেননি আম্পায়ার। সর্বোপরি, সেই সময়ের বেশ কিছু বোলারের মধ্যে বাদশাহ ছিলেন পরিপূর্ণ এক প্যাকেজ। তাঁকে প্রায়শই স্পট-বোলিং করতে দেখা যেতো, উইকেটে ক্যাপ রেখে, সেই ক্যাপে অনবরত স্পট বোলিং প্র‍্যাক্টিস করতেন তিনি। বর্তমান প্রতিযোগিতার ক্রিকেটেও খেলোয়াড়রা প্র‍্যাক্টিসের প্রতি যে অনীহা প্রকাশ করে আশির দশকে বাদশাহ’র ডেডিকেশান ছিলো ঠিক তার বিপরীত। নিজের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করার জন্য প্রচুর পরিশ্রম তিনি করেছেন।

বাংলাদেশের হয়ে খেলার সময়ে বাদশা একজন সত্যিকার, বড় ম্যাচের খেলোয়াড় ছিলেন; যিনি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলির জন্য তাঁর সেরা পারফরম্যান্স জমিয়ে রাখতেন। ১৯৮৫ সালে তিনদিনের ম্যাচে সফররত শ্রীলঙ্কা কে রীতিমতো বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন, নতুন বলে জাদুকরী সুইংয়ে লঙ্কান দুই ওপেনার সিদাথ উইটেমনি ও অমল সিলভা কে যথাক্রমে ৬ ও ০ রানে ফিরিয়ে দেন। রোহান মেন্ডিস, রয় দিয়াস নামের প্রতিষ্ঠিত দুই ব্যাটসম্যানকেও সে ম্যাচে তিনি সাজঘরে ফেরান। বাদশাহ’র অসাধারণ বোলিং নৈপূন্যে যে ম্যাচটি পরবর্তীতে ড্র হয়েছিলো।

তবে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে তিন দিনের ম্যাচে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে বাদশাহ’র পারফরম্যান্স ছিলো ঐতিহাসিক। ইমরান খান, আব্দুল কাদির এবং উইকেটরক্ষক মাসুদ ইকবালের উইকেটসহ তিন উইকেট নেন তিনি। বোলিংয়ের সাথে ব্যাট হাতেও আলো ছড়িয়েছেন সেদিন।

শক্তিশালী পাকিস্তান বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে সপ্তম উইকেট জুটিতে অধিনায়ক লিপু’র সাথে করেন ৬৩ রানের অনবদ্য এক পার্টনারশিপ। লিপু আউট হয়ে ফিরে গেলেও ৪৬ রান করে সেদিনের সর্বোচ্চ রানের মালিক ছিলেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। যদিও তাঁর সে ইনিংস ফলোঅনের সাথে দলের পরাজয় এড়াতে পারেনি, কিন্তু প্রতিপক্ষ ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে সমীহ পেয়েছিলেন ঠিকই।

৮৬’র মার্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ দল যখন ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামে বাদশাহ তাঁর সেরা ফর্ম ধরে রেখেছিলেন সেদিনও। পাকিস্তান কে দেয়া মাত্র ৯৪ রানের টার্গেট যখন সহজ মনে করেছে সবাই সেখানে পাকিস্তানের সহজ জয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান বাদশাহ। তাঁর নিয়ন্ত্রণ বোলিংয়ে এই রান প্রতিপক্ষের জন্য বিশালাকার রূপ ধারণ করে। নয় ওভার হাত ঘুরিয়ে ২৩ রানের বিনিময়ে দুই উইকেট নেন তিনি।

ধানমন্ডি ক্লাব দিয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট শুরু বাদশার। এরপর উদিতি, ন্যাশনাল স্পোর্টিং, আবাহনী, আজাদ বয়েজ, বিমান ক্রিকেট ক্লাব, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, পিডব্লুডি এবং শেষ করেন প্রথম ক্লাব ধানমন্ডিতে। সবচেয়ে বেশি ১০ বছর বিমানে খেলেছেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলেছেন। পাঁচটি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে খেলে দু’টো উইকেট পেয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দু’টো উইকেট দিয়ে আপনি কখনোই জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ কে পরিমাপ করতে পারবেন না!

নতুন বলে দারুণ সুইং করাতে পারতেন বেশ। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে তাঁর করা আউট সুইং গুলো রীতিমতো মরণফাঁদ ছিলো। জাতীয় দলের হয়ে তিনটি আইসিসি ট্রফি (’৭৯, ’৮২ ও ’৮৬) খেলে পেয়েছেন ২৫ উইকেট। ’৭৯ সালে ইংল্যান্ডের আইসিসি ট্রফিতে কানাডার বিপক্ষে ১৭ রানে এবং মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩৯ রানে চারটি করে উইকেট পেয়েছেন। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ওয়ানডে উইকেট শিকারি এই পেস বোলার ’৮৬’র এশিয়া কাপে পাকিস্তানের মহসিন কামাল এবং রমিজ রাজাকে এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেছিলেন।

কিন্তু তিন প্রজন্মের দুই প্রজন্ম হয়তো জানেই না, ক্রিকেটার জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা একজন বড়মাপের ফুটবলারও ছিলেন।

ফুটবলে ওয়ারীর হয়ে প্রথম বিভাগে যাত্রা। শাহীন স্কুল এন্ড কলেজের অধিনায়ক হিসেবে ঢাকা জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছেন। একসময় ফুটবলকেই বেশি সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন তিনি। ফুটবল খেলে টাকা পাওয়া যেতো প্রচুর; সেজন্য গুরুত্ব দিয়ে খেলেছেন ফুটবল। পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা জেলা এবং বিভাগের হয়ে খেলেছেন।

বাদশাহ এখন

১৯৭৩ সালে জাতীয় দলের হয়ে প্রথমবারের মতো খেলেন। লিগে ওয়ারীর পর খেলেছেন আবাহনীতে। ৭২ থেকে ৮১ খেলে আবাহনীতেই শেষ করেন ফুটবল ক্যারিয়ার। জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ ফুটবলে জনপ্রিয়তা পাননি কারণ, তখন দেশে অনেক বিখ্যাত ফুটবলার ছিলেন। এনায়েত, সালাউদ্দিনের মতো খেলোয়াড় ছিলেন তখন। এদেশের ফুটবলে লম্বা থ্রো‘র প্রচলন করেছেন তিনি!

ক্রিকেট ছেড়ে আসার এত বছর পরও মানুষ তাঁকে চেনে ক্রিকেটার বাদশা হিসেবে। কিন্তু নিজেকে সেভাবে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেননি তিনি। তিনি যখন ক্রিকেট খেলেছেন তখন ধারাভাষ্যকাররা দারুণ একটা মন্তব্য করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের রথীমহারথী হতে শুরু করে সবার মুখে মুখেই ছিল বাক্যটি – জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা ‘থ্রি কিংস ইন ওয়ান’। ধারাভাষ্যকাররা তাঁর নামের ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে ওটা বলেছিলেন।

শুধুই কি নামের ব্যাখা!

তিনি কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে চেষ্টা করেছেন ‘থ্রি কিংস ইন ওয়ান’ হতে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং প্রতিটি ডিপার্টমেন্টেই সেরা পারফরমার হতে চেষ্টা করেছেন; দলকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। হয়ত সে কারণেই মানুষ এখনো তাঁকে ক্রিকেটার হিসেবে মনে রেখেছে।

খেলোয়াড় হিসেবে একাধারে খ্যাতি পেয়েছেন অনেক, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন আর্থিকভাবেও। জগন্নাথ কলেজ থেকে ব্লু পেয়েছেন ১৯৭৩ সালে। সম্মানিত হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির পুরস্কারে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৩ সালে। দেশের একটি দৈনিক ক্রীড়াবিদদের মধ্যে জরিপ চালিয়েছিল। সেখানেও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন এই জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ!

লিখার শুরুতেই একটা প্রশ্ন করেছিলাম; বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা পেস বোলার কে! সেরা বাছাইয়ের কাজটা আসলেই অনেক কঠিন! তারপরও অনেকেই তো জানতে চায়। সেরা কী শুধু বোলিং দিয়ে হয়? নাকি পরিসংখ্যান দিয়ে? সেরা হয় অনেক কিছু মিলিয়ে। আর সে সেরা মাশরাফি। কেন? মাশরাফি ইজ অ্যা বর্ন লিডার, বর্ন ফাইটার।

পুনরায় ফ্যান্টাসি তে ফিরে যাই; আপনি কল্পনা করতে শুরু করুন, একজন আহত সৈনিক ময়দানি যুদ্ধে একটা পুরো সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ! তাও আবার সবার সামনে দাঁড়িয়ে! তাঁর দু’পায়ে সাতটা বুলেটের আঘাত। কী অবিশ্বাস্য! হ্যাঁ আমি মাশরাফিকে আহত যোদ্ধা হিসেবেই এগিয়ে রাখছি। একজন মাশরাফি তাঁর জীবনে কখনো পুরোটা দিয়ে খেলতে পারলেন না। তাতেই তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন। যদি পুরোটা দিতেন, বাকীদের নামই তো শুনতে হতো না। মাশরাফি সেরা; কোনো সন্দেহ ছাড়াই সেরা।

আমি নেতা মাশরাফির কথা বলছি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মতে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক। সেরা পেস বোলারও বটে। প্রতিটা খেলোয়াড় কেমন মাশরাফি ভাই, মাশরাফি ভাই করে। এটা কী এমনি এমনি হয়? আমরা তো কতো ক্যাপ্টেন দেখলাম। এরকম ক্যাপ্টেন দেখিনি। পুরো দল যেন উনার সন্তান। আমি মুগ্ধ এই মানুষটা কে দেখে। ক্যাপ্টেন ম্যাশ, তাঁর সঙ্গে কারো তুলনা চলে না।

আরেকটা প্রশ্ন; বর্তমান বিশ্বের সেরা পেস বোলার কে? তর্ক হতে পারে তবে এই মুহূর্তে যে অ্যান্ডারসন বিশ্বের সেরা সুইং বোলার সেটা মানবে যে কেউ! বুড়ো বয়সে এসেও বাইশগজে পিচের দুপাশ থেকে যেভাবে সুইংয়ের পসরা সাজান সেটা বোধকরি অনেক পেসারদের জন্য রীতিমতো স্বপ্ন। সাপের মতো বেঁকে যাওয়া বল খেলতে হিমশিম খান সব ব্যাটসম্যান। একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কাইরন পাওয়েলকে ব্যানানা সুইংয়ে আউট করেছিলেন। ব্যানানা সুইং বলতে বোঝায় যে বল বাতাসেই কলার মতো বেঁকিয়ে সুইং খায়। ইউটিউবে সার্চ দিলেই পাবেন। আহ! কি বাঁকানো সুইং! এই মুহূর্তে জিমি অ্যান্ডারসন থেকে সেরা বোলার টেস্ট ক্রিকেটে নেই তর্কসাপেক্ষ যেকেউ মেনে নিতে বাধ্য।

পাবলো পিকাসোর তুলির আঁচড় কিংবা জন মিলটনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ কিংবা ওয়াসিম আকরামের পুরোনো বলে রিভার্স সুইং অথবা নতুন বলে জিমির হাতের বলে সাপের নাঁচন! আমার কাছে সব এক! টেস্ট বোলিং যে এর থেকে সুন্দর হতে পারে না! ইংলিশ মিডিয়া লাল ডিউক বলকে প্রায় সময় বলে থাকেন ‘রেড চেরী’। ওয়াসিম আকরাম যদি সেই চেরীর সম্রাট হয়ে থাকেন, তাহলে জিমি অ্যান্ডারসন নিঃসন্দেহে সেই চেরীর যোগ্য জমিদার। আর জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ সুইং বোলিংয়ে আমাদের মুকুটহীন এক রাজকুমার।

বাদশাহ বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার প্রায় দশবছর আগেই তাঁর ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। কিন্তু এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে বাদশাহ থাকলে তিনিই থাকতেন বাংলাদেশ দলের প্রথম টেস্ট ম্যাচে পেস বোলিংয়ের নেতৃত্বে! ইনসুইং, আউট সুইং বা রিভার্স সুইং; তাঁর নামের পাশে যোগ হতো বাহারি সব বিশেষণ।

বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে বহুবার মুখোমুখি হয়েছেন সাংবাদিকদের সামনে। বাংলাদেশের ক্রিকেট কতটুকু এগিয়েছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ’র সহজ স্বীকারোক্তি, ‘আমাদের ক্রিকেট এগিয়েছে, অবশ্যই অনেক এগিয়েছে। সমালোচকরা অনেক কিছুই বলবে। বুড়োরা বলবে, তাদের সময়কার ক্রিকেট সেরা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হল, এখনকার ক্রিকেট অনেক এগিয়েছে। স্কিলফুল ক্রিকেটার যুগে যুগে আসে-যায়। কিন্তু এরা আধুনিক ক্রিকেট খেলে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াই করে। বাংলাদেশ এগোচ্ছে, বাংলাদেশের ক্রিকেট এগোচ্ছে।’

হ্যাঁ বাংলাদেশ ক্রিকেটে এগোচ্ছে; এগোচ্ছে আমাদের স্বপ্নের পরিধিও। স্বপ্নভঙ্গের হাজারটা গল্পের শেষে একদিন হয়তো ছিনিয়ে আনবে সোনালী ট্রফি বা তারচেয়ে বেশি কিছু; কিন্তু আর কেউ কি পারবে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট শিকারী হতে! না, সেই নাম তো কেবল একজনের জন্যই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা থাকবে। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট কে এক নজরে দেখতে গেলে তার প্রথম পাতায় দেখা যাবে জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ কে।

তিনি জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। বাদশাহ নাম না শোনাটা আমাদের ক্রিকেটভক্তদের জন্য কোনো মনীষির নাম না শোনার মতোই অপরাধ। কারো কারো মতে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের একজন, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ। দ্য অ্যাংরি ইয়ংম্যান জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link