বিপ্লবের দর্শন, বিদ্রোহের কাব্য

‘ফুটবল খেলাটা খুবই সহজ তবে সহজ ফুটবল খেলা খুবই কঠিন।’ বাইশ জন মিলে চামড়ার বলের খেলাটা নিয়ে এরচেয়ে বড় ধ্রুব সত্য আর কি হতে পারে। আর এই ধ্রুব সত্য শোনা মাত্রই মনের পর্দায় কার ছবিটা ভেসে ওঠে?

হ্যাঁ, কথা বলছি একজন কবিকে নিয়ে, যিনি পা দিয়ে লিখে গিয়েছেন কতশত ছন্দ। তিনি ক্রুইফ, হেনড্রিক ইয়োহান ক্রুইফ। আধুনিক ফুটবলে তার দর্শনের প্রভাব এতটাই বেশি যে ‘আধুনিক ফুটবলের জনক ক্রুইফ’ – বললে খুব একটা ভুল হয় না। তিনি স্তুতিবাক্যের ধার ধারেননি কখনো, তবু স্তুতিতেই বসবাস তাঁর।

আয়াক্স অ্যামস্টারডামের হয়ে ইউরোপীয় ফুটবলে পথচলা শুরু। শুরু ইতিহাস লেখারও। সেখানে রিনাস মিশেলসকে সাথে নিয়ে আয়াক্সকে জিতিয়েছিলেন টানা তিন ইউরোপিয়ান কাপ। উচ্চভিলাসহীন আয়াক্সকেই তৎকালীন ইউরোপের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রতদান দিতে ভোলেনি ডাচ ক্লাবটি। আয়াক্স ক্রুইফের সম্মানে তাদের স্টেডিয়াম নাম রেখেছিল ‘ইয়োহান ক্রুইফ অ্যারেনা’। এছাড়া চিরদিনের জন্য তুলে রেখেছে ক্রুইফের বিখ্যাত ১৪ নম্বর জার্সিটি।

আয়াক্সে থাকাকালীন ডাক এসেছিল দুই স্প্যানিশ প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার থেকে। রিয়ালের বড় অংকের টাকা নয় বরং অগ্রাধিকার পেয়েছিল হৃদয়ের বার্সেলোনা-প্রীতি। তাই হয়তো তৎকালীন টাকার খনি রিয়াল মাদ্রিদকে বারন করে দরিদ্রতার কুটির কাতালুনিয়াতে আসা।

শুধু আসা বললে ভুল হবে, তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এফসি বার্সেলোনার নতুন ইতিহাসও। হারতে থাকা বার্সেলোনাকে শিখিয়েছিলেন জিততে; স্বমহিমায় কাতালান ক্লাবকে দিয়েছিলেন অন্যরূপ। নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন ‘কাতালুনিয়ার ক্রুইফ’ হিসেবে। আর সমর্থকরা ভালবেসে নাম দিয়েছিল ‘El Salvador’ যার অর্থ হল ‘ত্রাণকর্তা’।

আলোর নিচেই তো আঁধার। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।১৯৭৪ এর বিশ্বকাপ। হলান্ডদের কমলা জার্সি গায়ে একে একে সব বাঁধা ডিঙ্গিয়ে আরাধ্য সোনালী ট্রফি থেকে ছিলেন মাত্র ৯০ মিনিট দূরেই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ফাইনালে যেন ছায়া হয়ে গেলেন নিজের; নেদারল্যান্ডস দলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল সেদিন।

কথিত আছে, ম্যাচের আগে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হওয়াতেই নাকি মানসিক ভাবে স্থির ছিলেন না। টূর্নামেন্টের শুরু থেকেই দুর্দান্ত ফুটবল খেলা ক্রুইফ সোনালী বলটা অবশ্য জিতেছিলেন তবু ভাগ্যটা পাশে থাকলে শুধু বিশ্বকাপের সোনালী বল নয়, সোনালি ট্রফিটাও তার হাতেই শোভা পেত। তাতে অবশ্য কিই বা যায় আসে। একটা ট্রফি দিয়ে তো আর ক্রুইফকে বিচার করা যায় না।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত ছিলেন ক্রুইফ। যেমন প্রতিবাদ করেছিলেন কাতালুনিয়ার উপর অত্যাচারের, তেমনি আর্জেন্টিনায় চলা গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ঘোষনা দিয়েছিলেন হত্যামঞ্চ থেকে হাতে গোনা দূরত্বে ফুটবল খেলা যায় না। ১৯৭৮ এর বিশ্বকাপে সেবার আর্জেন্টিনা যাওয়া হয়নি, বলা যায় নিজেই যাননি খেলতে। নিজের জায়গা থেকে এভাবেই সর্বোচ্চ বিদ্রোহ ঘোষনা দিয়েছিলেন সকল অপরাধ আর অন্যায় এর বিরুদ্ধে।

কি আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন ইয়োহান ক্রুইফ! শুধুমাত্র মতাদর্শের সাথে অমিল পাওয়ায় বিশ্বকাপে নিজ দেশ হলান্ডকে সমর্থন না করে করেছিলেন স্পেনকে। কাতালুনিয়ার হয়ে এত এত সাফল্য পেয়েও ন্যু ক্যাম্পে থাকেননি শুধু নিজের আদর্শের সাথে ক্লাব-প্রেসিডেন্ট এর মিল না হওয়ায়। নজরুলের ভাষায় একেই নিশ্চয় বলে, ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’

মাঠে ক্রুইফ তৈরি করেছিলেন ‘টোটাল ফুটবল’ নামে অদ্ভুত এক ফুটবলের। যে ফুটবলের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো সকলে। ফুটবলের মাঠে নতুন করে এনেছিলেন থ্রু পাস। ক্রুইফ টার্ন-তো তারই নামেই, আজও তা অনুকরনীয়। প্লে মেকিং-কে দিয়েছিলেন শিল্পের রূপ। ফুটবলের সর্ব্বোচ্চ ব্যক্তিগত অর্জন ব্যালন ডি’অর পুরষ্কার নিজের করে নিয়েছিলেন তিনবার। ডাগ আউটে দাঁড়িয়েও তিনি ছিলেন শতভাগ সফল; সহজ ফুটবল খেলার কঠিন কাজটাই শিখিয়ে গিয়েছিলেন শিষ্যদের।

কি অবলীলায় ইয়োহান ক্রুইফ সৃষ্টি করেছেন নিজের সত্তা, কি অবলীলায় বদলে দিয়েছেন ফুটবলকে। শুধু খেলাতেই নয়, তিনি নজর কেড়ে নিয়েছিলেন আধুনিকতাতেও। সেই যুগেই তার ব্যক্তিগত স্পন্সর শোভা পেত, ছিল ব্যক্তিগত এজেন্ট।

আয়াক্স থেকে ন্যু ক্যাম্প, যেখানে গিয়েছেন রেখেছেন নিজের পদচিহ্ন; বিপ্লব ঘটিয়েছেন সেখানে। ক্রুইফের হাতেই নবজন্ম বার্সেলোনার একাডেমি লা মাসিয়া’র। যে লা মাসিয়া থেকেই ঘষেমেজে তৈরি করা লিও মেসি, ইনিয়েস্তা-রা বিশ্ব শাসন করেছেন।

প্রবল আত্মবিশ্বাসী ক্রুইফের গর্বিত স্বীকারোক্তি ছিল এমন, ‘আমি তখনই কোচ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যখন আমাকে বলা হয়েছিল আমি সেটা পারবো না।’ তিনি ঔদ্ধত্যের সাথেই বলেছিলেন, ‘আমি ধার্মিক নই। স্পেনে বাইশ জন খেলোয়াড়ই মাঠে প্রবেশ করার পূর্বে বুকে ক্রুশ আঁকে। যদি এটা সত্য হত তবে সব ম্যাচ ড্রতেই নিষ্পত্তি হত।’

আত্মসত্তা আর দাম্ভিকতার কি দারুন এক মিশেল। তিনি ফুটবলকে ভালবেসেছিলেন, ফুটবলকেই বানিয়েছিলেন ধ্যান জ্ঞান। টাকা দিয়ে ফুটবলার কেনা নয়, ফুটবলার তৈরি করে নেয়াই ছিল পছন্দ। তাই হয়তো আমৃত্যু ফুটবলের সাধনা করে গিয়েছিলেন এই সাধক। কোন দ্বিধাদ্বন্দ ছিল না তার মাঝে; সাবলীল ভাষায় বলে দিয়েছিলেন, ‘যদি আমি কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নি, তবে ভেবে নিও সেটা ভুল ছিল না।’

ক্রুইফর অন্তধার্ন ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে অর্ধ-যুগ। তবু তিনি রয়েছেন অগুনিত ভক্ত-সমর্থকদের হৃদয়ের গভীরে। তিনি বেঁচে আছেন তার সৃষ্টির মাঝেই। এখনো তাকে অনুকরন করে ফুটবলের সবুজ ক্যানভাসে তুলির আঁচড় পড়ে যাচ্ছে। এখনো ক্রুইফের মতই ফুটবলটা খেলে যাচ্ছে তার বার্সেলোনা।

ইয়োহান ক্রুইফ একজন ডাচ দার্শনিক, একজন ফুটবল সন্ন্যাসী তিনি; যিনি সিগারেটে টান দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘টাকা তোমাকে কখনো ম্যাচ জেতাতে পারবে না। তুমি কখনো টাকার বস্তাকে গোল করতে দেখেছ?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link