কেবল ক্রিকেট নয়, পরিসংখ্যান বিশ্বাস করলে মানতে হবে, জন বুকানন খেলাধুলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ কোচদের মধ্যে একজন।
ওয়ানডে এবং টেস্ট বিবেচনায় সফলতার হার ৭৯.৮৩ শতাংশ। ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কোচ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ভিন্স ল্যাম্ববর্ডিকে। তাঁর সফলতার হার ৭৩.৮০। জন বুকানন শুধু ভিন্স ল্যাম্ববর্ডির থেকে ভালো নন, বর্তমান সময়ের সেরা কোচ স্যার আলেক্স ফার্গুসনের থেকেও বেশ ভালো ছিলেন।
জন বুকানন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে যত ম্যাচ জিতেছেন এবং ট্রফি জিতেছেন তাঁর জন্য তাঁর প্রশংসা হওয়া উচিত ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সাফল্যের থেকে প্রশংসা বেশ কমই পেয়েছিলেন তিনি।
ক্রিকেট বিশ্বে কোচের ধারণাটা বেশ নতুন। ক্রিকেটে কোচের ধারণাটা এসেছে গত শতাব্দীর শেষের দিকে। ক্রিকেটের মত অন্যসব দলগত খেলাতে কোচের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু ক্রিকেটে কোচের পাশাপাশি আরেকজন গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি থাকেন তিনি হলেন দলের অধিনায়ক।
ক্রিকেটের শুরু থেকে কোচের ভূমিকা ছিল একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে তুলে আনার জন্য। পেশাদার ক্রিকেটে কোচ আসবে সেটা আগে কখনো ধারণা করা হয়নি। ক্রিকেটের শুরুর দিকে কোচের ভূমিকা ছিল একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটারকে তুলে নিয়ে আসা এবং তার পরিচর্যা করা।
যখন ১৯৮৬ সালে বব সিম্পসন অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের পূর্ণকালীন কোচ হিসেবে নিয়োগ পান তখন এই সিদ্ধান্তটির অনেক বেশি সমালোচনা করা হয়েছিল। কোচের বিষয়ে ২০০৭ সালে ইয়ান চ্যাপেল হেরাল্ড সানকে বলেন, ‘ক্রিকেটে অধিনায়কের গুরুত্ব ৯৫ শতাংশ এবং কোচের ভূমিকা ৫ শতাংশ।’
কোচ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তী লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন আরো একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘কোচিং করাবেন ১২ বছরের ছেলেদের, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের নয়।’
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে যখন বব সিম্পসনকে নিয়োগ দেয়া হয়, তখন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে কোনো অধিনায়কই স্থায়ী হতে পারছিলেন না। পাঁচ বছরে চারজন কোচকে পরিবর্তন করে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড। বব সিম্পসনের পর এই কোচের পদটি স্থায়ী হয়ে যায়। বব সিম্পসনের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন জিওফ মার্শ। জিওফ মার্শ ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব নেবার পর অস্ট্রেলিয়া দল ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ জেতার পথে অনেকটা এগিয়ে যায়। জিওফ মার্শের পর দায়িত্বে আসেন জন বুকানন।
যখন জন বুকানন অস্ট্রেলিয়ার দায়ত্ব নেন তখন তিনি ছিলেন ৪৬ বছর বয়সী একজন কোচ। তিনি ক্রিকেট কোচিং এর উপর পড়াশুনা করেন গ্রেগ চ্যাপেল ক্রিকেট সেন্টার থেকে। এছাড়াও ‘হিউম্যান মুভমেন্ট’ বিষয়ের উপর স্নাতকোত্তর করেছেন কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অস্ট্রেলিয়ার দায়িত্ব নেবার আগে জন বুকানন পাঁচ বছর কোচিং করিয়েছিলেন কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেট দলকে। তাঁর কোচিং এই ১৯৯৪-৯৫ সালে শেফিল্ড শিল্ডের শিরোপা জেতে কুইন্সল্যান্ড। এছাড়াও ইংল্যান্ডের ওল্ডহাম,ক্যামব্রিজশায়ার এবং মিডলসেক্স দলেও কোচিং এর অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর।
জন বুকাননের ক্রিকেটার জীবন খুব বেশি ভালো ছিল না। তিনি মাত্র সাতটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। তাতে করেছিলেন মাত্র ১৭০ রান। তাঁকে যখন অস্ট্রেলিয়া দলের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন বেশ সমালোচনা করেছিলেন বড় বড় ক্রিকেট বোদ্ধারা।
প্রশ্ন উঠেছিল মাত্র সাতটি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ খেলা কোচ কিভাবে একটি বিশ্বকাপ জয়ী দলের কোচ হতে পারে।
পরবর্তীতে জন বুকানন এইসব সমালোচনা নিয়ে কথা বলেন। ২০০৯ সালে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘সাবেক ক্রিকেটারদের মত আমি অনেক কিছু নিয়ে ঘুরি না। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমি সব কিছু ক্রিকেটীয় চোখ দিয়ে দেখি। সাধারণত আমি সব কিছু একটু ভিন্ন ভাবে দেখি।’
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের পর জাতীয় দলের দায়িত্ব নেবার পর তাঁর কোচিং এর প্রভাব বুঝতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া দল। ড্যামিয়েন ফ্লেমিং সিডনি মর্ণিং হেরাল্ডে লেখা এক কলামে বলেছিলেন, ‘তিনি আমাদেরকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। আমরা দল হিসেবে ভবিষ্যতের জন্য কি রকম উত্তরাধিকার রেখে যেতে চাই? দায়িত্ব নেবার পর তিনি আমাদেকে পিরামিড একে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ জেতার পরিকল্পনা বুঝিয়েছিলেন।’
বুকানন ক্রিকেট কোচের থেকে বড় একজন মানসিক প্রশিক্ষক এবং চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি কিছু অভিনব কৌশলের পরামর্শ দিয়েছিলেন যা ক্রিকেটের পুরাতন ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এর মধ্যে ছিল টেস্ট ম্যাচে দুর্দান্ত ভাবে রান করা এবং ওয়ানডে আক্রমণাত্মক ভাবে খেলা। তিনি টেস্ট ক্রিকেট নাইট ওয়াচম্যানও করতে চাইতেন না। এছাড়াও বলেন, ‘আমরা সব সময় আগ্রাসী ছিলাম এবং ভাবতাম কিভাবে প্রতিপক্ষকে হারাতে পারি।’
জন বুকাননের অধীনেই ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্য বিস্তার বেড়েছে। তাঁর অধীনেই অস্ট্রেলিয়া দুইবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। এছাড়াও ৮৯ টেস্টের মধ্যে ৭০ টেস্ট জিতেছিল তাঁর সময়ে। আর বুকাননের সময়ে ৩৫ ওয়ানডেতে মাত্র ৬ বার হারের মুখ দেখেছিল অস্ট্রেলিয়া দল।
জন বুকাননের সময়ে অস্ট্রেলিয়া টানা তিন বার অ্যাশেজ সিরিজ জিতেছিল। এছাড়াও তাঁর সময়েই অস্ট্রেলিয়া দল ৩৬ বছর পর যখন ভারতকে ভারতের মাটিতে হারায়। টেস্ট-ওয়ানডে মিলে তাঁর ম্যাচ জয়ের সাফল্য ছিল ৭৯.৮৩। যা কিনা ক্রীড়া ইতিহাসের সেরা কোচ ভিন্স লম্বার্ডি (৭৩.৮০) এবং স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের (৫৮.০২) এর থেকে অনেক উপরে। যদি কোচদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে পরিসংখ্যান একমাত্র উপায় হত, তাহলে নিঃসন্দেহে সেরা কোচ হতেন জন বুকানন।
শেন ওয়ার্ন এবং জন বুকাননের মধ্যে বেশ কিছু দ্বন্দ্ব ছিল। শেন ওয়ার্ন কয়েকবারই জন বুকাননকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এছাড়া ২০০৩ সালে মাদক কেলেঙ্কারির কারণে জন বুকাননের পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন শেন ওয়ার্ন। এছাড়াও ২০০৬ সালে অ্যাশেজের আগে হওয়া বুট ক্যাম্প নিয়েও বেশ বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন শেন ওয়ার্ন।
এই নিয়ে জন বুকানন বলেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমি এবং শেন যেসব বিষয় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করি না কেন সেটা কোনো সংবাদ নয়। আমি সব সময় বলি অস্ট্রেলিয়া দলের স্বাস্থ্যকর বিষয় হলো সবার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।’
গিডন হাই সাম্প্রতিক সময়ে একটি বইয়ে বলেছেন, ‘বুকানন এবং ওয়ার্ণ কখনো একই পৃষ্ঠায় থাকার কথা ছিল না। একটু হলেও একই বইয়ে থাকতে পারে।’
বুকানন তাঁর বইয়ে কিছু মানুষকে রেখেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হলেন স্টিভ ওয়াহ। স্টিভ ওয়াহ ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক এবং কোচের সাথে এগিয়ে এসেছিলেন।
স্টিভ ওয়াহ তাঁর আত্মজীবনী আউট অফ মাই কমফোর্ট জোনে বলেছেন, ‘আমি তাঁকে কোচের থেকে একজন প্যারফর্মেন্স ম্যানেজার হিসেবে বেশি দেখি। তিনি শুধু ক্রিকেট বিষয়ক বিষয়েই নয় অন্য বিষয়েও সমাধান করার চেষ্টা করবেন। এর ফলে প্রত্যেকটা ক্রিকেটার বেশ ভালো ভাবেই ক্রিকেটে মনযোগ দিতে পারে। আমরা বিভিন্ন ভাবে দলের সদস্যদের উজ্জীবিত করতে চাই এর ফলে ক্রিকেটারদের মধ্যে বেশ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়। আর এটা দলের মধ্যে স্বাস্থ্যকর একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।’
স্টিভ ওয়াহের সাফল্যের পর দায়িত্ব পান রিকি পন্টিং। যিনি কিনা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। তাঁর সময়েও কোচ হিসেবে ছিলেন জন বুকানন। জন বুকানন পন্টিং এর সাথে মিলে ২০০৬-০৭ সালের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডকে ৫-০ তে হোয়াট ওয়াশ করে।
শেন ওয়ার্ন বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া দলে খুব বেশি ভালো কোচের দরকার নাই। আমার ১৩ বছরের ছেলেও সিদ্ধান্ত নিতে পারে অস্ট্রেলিয়া দলে কে বোলিং করবে।’
পন্টিং জন বুকাননকে নিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা প্রতিভাবান। কিন্তু প্রতিভা দিয়ে সব কিছু জয় করা সম্ভব নয়। সে আমাদের কাছ থেকে বেশ ভালো ভাবে কাজ বের করে আনতে পারে। সে আমার কাছ থেকে এবং ল্যাঙ্গার, হেইডেন, ওয়াহের কাছ থেকে খেলা বের করে আনতে পারেন। এমনি ওয়ার্ন এবং ম্যাকগ্রার কাছ থেকেও।’
জন বুকানন এমন একজন কোচ যিনি কিনা চাকরি হওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবে না। এমনকি তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করলেও সে কোনো কথা বলবে না। তিনি সবসময় চলমান অনুশীলন নিয়ে কথা বলেন।
২০০৮-০৯ সালে আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সকে নিয়ে পরাজয়ের পর বলেন, ‘আপনি যদি সব সময় সফল হন, তাহলে আপনি কিছু শিখতে পারবেন না।’ সেই আইপিএলের পর থেকেই তিনি বিলীন হতে থাকেন। আর ক্রিকেট বিশ্বে এখন তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না!