খেলোয়াড় জীবনে যার কাছে টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টির কোন ভেদাভেদ ছিল না, ব্যাটিংয়ে মূলমন্ত্র যার কাছে ছিল শুধুই আক্রমণ – সেই ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যখন কোচ হয়ে ড্রেসিং রুমে এসেছেন তখন যে তাঁর কৌশলে কোন পরিবর্তন আসবে না সেটি নিশ্চিতই ছিল। ঘটেছেও তাই, ধৈর্যের খেলা টেস্টে এখন উল্টো বোলারদের শাসন করা শুরু করেছে ইংলিশ ব্যাটাররা।
ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ডাক নাম ‘বাজ’। শৈল্পিক এই ডাকনামের সঙ্গে মিলিয়ে তার এই আক্রমনাত্মক মানসিকতাকে বলা হয় ‘বাজ-বল’। আর ম্যাককালামের প্রথম সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই দেখা মিললো বাজ-বলের সাফল্য। আক্রমনাত্মক ক্রিকেটে ব্ল্যাকক্যাপসদের স্রেফ উড়িয়ে দিয়েছে ইংলিশরা। এবার সর্বশেষ এশিয়ান পরাশক্তি ভারতকেও অবিশ্বাস্য পরাজয় উপহার দিয়েছে ম্যাককালামের শিষ্যরা।
হ্যাঁ, শিষ্যরা। ম্যাককালামের পুরো পরিকল্পনা ভজকট হয়ে যেত যদি তার শিষ্যরা সেটা মাঠে করে দেখাতে না পারতেন। আরো স্পষ্ট করে বললে একজন জনি বেয়ারস্টো না থাকলে হয়তো এতটাও বিধ্বংসী হয়ে দেখা যেত না ইংল্যান্ড টেস্ট দলকে। কোচের আক্রমনাত্মক ক্রিকেটকে একেবারে হৃদয়ঙ্গম করেছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। মিডল অর্ডারে নেমে ব্যাট করেছেন ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি স্টাইলে।
ব্রেন্ডন ম্যাককালাম দায়িত্ব নেয়ার পর এখন পর্যন্ত চার ম্যাচ খেলেছে ইংল্যান্ড, চারবারই রান তাড়া করতে নেমে জয়ের হাসি হেসেছে তারা। আর সেই চার ম্যাচের মাঝে শেষ তিন টেস্টে বেয়ারস্টোর ইনিংসগুলো যথাক্রমে ৮(১১), ১৩৬ (৯২), ১৬২ (১৫৭), ৭১ (৪৪), ১০৬ (১৪০),১১৪ (১৪৫)। ধারাবাহিক, বিধ্বংসী, কার্যকর – বেয়ারস্টোর এমন পরিসংখ্যানকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় সেটি খুঁজে বের করা একটু কঠিনই বটে।
সবমিলিয়ে ছয় ইনিংসে চারটি শতক আর একটি অর্ধশতক। এছাড়া শেষ তিনবারই ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন এই আগ্রাসী ব্যাটসম্যান। এর মাঝে ভারতের শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে জোড়া সেঞ্চুরি আরো বিশেষভাবে নজর কেড়েছে।
প্রথম ইনিংসের কথাই ধরা যাক, ৪৪ রানে তিন ব্যাটসম্যান ফিরে যাওয়ার পর মাঠে এসেছিলেন জনি বেয়ারস্টো। এরপর ক্রিজে থেকেই দেখেছেন জো রুট এবং জ্যাক লিচের বিদায়। বেয়ারস্টো নিজে শুরুতে ছিলেন খোলসের ভিতর, কিন্তু বিরাট কোহলির এক স্লেজিং বদলে দেয় তাকে। পুরোদমে টি-টোয়েন্টির মত ব্যাট চালাতে শুরু করেন। স্টোকস আর বিলিংসদের সাথে ছোট ছোট জুটি করে দলকে এনে দেন সম্মানজনক সংগ্রহ, নিজেও পেয়ে যান তিন অঙ্কের দেখা।
তারপরও ইংল্যান্ড পিছিয়ে ছিল ১৩২ রানে, বিশাল লিডের নিচে চাপা পড়া ইংলিশরা দ্বিতীয় ইনিংস ৩৭৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমেছিল। শুরুটা ভাল হলেও পরপর তিন উইকেট হারানো স্টোকস বাহিনীর সামনে তখন হাতছানি দিচ্ছিলো পরাজয়।
কিন্তু, ব্যাটকে অস্ত্র বানিয়ে সেই শঙ্কার কালো মেঘকে উড়িয়ে দেন বেয়ারস্টো। রুটের সঙ্গে ২৬৯ রানের রেকর্ড জুটিতে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন তিনি। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরষ্কারও ওঠে এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানের হাতে।
ক্রিকেটার হিসেবে খুব প্রতিভাবান কেউ ছিলেন না। কিন্তু অসম্ভব দৃঢ়তা আর পরিশ্রমের কল্যাণে এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। টেকনিক্যালি আপনি তার ব্যাটিংয়ে ভুল খুঁজে পাবেন, তিনি সতীর্থ জো রুটের মত কপি বুক ক্রিকেটটা খেলতে জানেন না। কিন্তু এই নীল চোখ আর লাল চুলের ভদ্রলোক একবার চালকের আসনে বসতে পারলে, অবিশ্বাস্য কিছু করে ফেলা বেশ সহজই মনে হবে।
অবশ্য সবসময় একই পরিস্থিতি ছিল না জনি বেয়ারস্টোর জন্য। ব্রেন্ডন ম্যাককালামের আগমনের পূর্বে সাদা পোশাকে ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারছিলেন না তিনি। রঙিন পোশাকে পারফরম্যান্স লাল বলে দেখাতে না পারায় একাদশে আসা যাওয়ার মাঝেই থাকতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু, একজন কিউই কোচ বদলে দিয়েছেন ভাগ্য। তবে ম্যাককালাম হয়তো শুধুই পথটা বাতলে দিয়েছেন, এমন অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের সবটুকু আসলে বেয়ারস্টোর পরিশ্রম আর ইচ্ছেশক্তির ফল।
খারাপ সময় কাটিয়ে এখন ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে আছেন জনি বেয়ারস্টো। এমন উড়ন্ত ফর্ম ধরে রাখতে পারলে সাদা পোশাকেও দ্রুতই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন তিনি। ব্রেন্ডনের ব্যাজ-বল আর বেয়ারস্টোর বিধ্বংসী ক্রিকেটটা বসন্ত হয়েই এসেছে ইংল্যান্ডের জন্য। এখন দেখার বিষয় সামনে অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা কিংবা এশিয়া সফরের সময় এই বসন্ত স্থায়ী হয় কি না।