১৯৯৯ সালের ১০ জুন – এই দিনে ল্যান্স ক্লুজনার আউট হয়েছিলেন!
ভাবছেন, এটা আবার বলার কী হলো, ব্যাটসম্যান তো আউট হতেই পারেন! হ্যাঁ, ব্যাটসম্যানদের আউট হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে বলছি ১৯৯৯ বিশ্বকাপের কথা, ল্যান্স ‘জুলু’ ক্লুজনারের আউট হওয়া যখন অস্বাভাবিক।
ওই বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন তখন, ক্লুজনার কোন ম্যাচে আউট হবেন? ‘এই ম্যাচেই আউট হবেন কিনা’, ‘কোন বোলার আউট করতে পারবেন’, এসব নিয়ে মিলিয়ন ডলারের বাজি হচ্ছিল প্রতি ম্যাচের আগেই।
ক্লুজনারের অপরাজেয় যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ থেকে। অকল্যান্ডে তিন নম্বরে নেমে অপরাজিত ছিলেন ১৩২ বলে ১০৩ রান করে। পরের ইনিংসে আটে নেমে ১৯ বলে ৩৫ করে দলের রোমাঞ্চকর জয়ের নায়ক। পরের দুই ম্যাচে ৭ বলে অপরাজিত ১৩ ও ২৬ বলে অপরাজিত ৩৫।
এরপর বিশ্বকাপ। প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে রান তাড়ায় শেষ দিকে নেমে ৪ বলে অপরাজিত ১২। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যখন উইকেটে গেলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার রান ৭ উইকেটে ১১৫। সেখান থেকে ৪৫ বলে অপরাজিত ৫২ করে দলকে নিয়ে গেলেন ১৯৯ রানে। পরে বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে দলকে জেতালেন ৮৯ রান।
ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০ বলে অপরাজিত ৪৮। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলের অপ্রত্যাশিত হারের ম্যাচে ৫৮ বলে অপরাজিত ৫২।
পরের প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। রান তাড়ায় শেষ ৫ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৪৪ রান। তখনকার দিনে অনেক কঠিন। বোলিংয়ে শোয়েব আখতার, ওয়াসিম আকরাম। ক্লুজনার স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন! শোয়েবের একটি ছক্কা এখনও চোখে ভাসে। ৯০ মাইল গতি, মোটেও শর্ট বল নয়, লেংথ ডেলিভারি। ক্লুজনার হয়তো অনুমান করতে পেরেছিলেন। চোখের পলকে বলটা পিক করে, সামনের পা মিড উইকেটের দিকে সরিয়ে চালিয়ে দিলেন, ব্যাট স্পিড দুর্দান্ত। বল গ্যালারিতে!
একটু পর ওয়াসিম আকরামকেও ঠিক একইভাবে, লেংথ বল পুল করে (বলা ভালো, বেস বল স্টাইলে) প্রায় একই জায়গা দিয়ে ছক্কা। ওই ম্যাচে ৪১ বলে ৪৬ করে আবারও দলের দারুণ জয়ের নায়ক।
প্রথম ম্যাচের পর দলের চার জয়ের সব কটিতে তিনি ম্যান অব দা ম্যাচ। কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটিতে ব্যাটিং পাননি, বোলিংয়ে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা।
এরপর ১০ জুন, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াই এজবাস্টনে। যথারীতি ওই ম্যাচের আগে বাজির দর উঠেছে তরতর করে, কে আউট করবেন ক্লুজনারকে! ওই বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা জেফ অ্যালটের পক্ষে দর ছিল বেশি। ডিওন ন্যাশ, ক্রিস কেয়ার্নস, ক্রিস হ্যারিসের পক্ষেও ছিল ভালো দর। সেভাবে আলোচনায় ছিলেন না যিনি, বহু কাঙ্ক্ষিত শিকারটি ধরেন তিনিই। জেন্টল মিডিয়াম পেসার, ‘ডিবলি-ডবলি’ বোলিংয়ের গুরু, গ্যাভিন লারসেন!
বিশ্বকাপে আগের সব ম্যাচে ৭-৮-৯ নম্বরে ব্যাট করলেও সেদিন তিন নম্বরে পাঠানো হয় ক্লুজনারকে। গিয়েই ন্যাথান অ্যাস্টলের বলে দুর্দান্ত এক স্ট্রেট ড্রাইভে চার মেরেছিলেন। এরপর আপাতত নিরীহ এক বল, ডেলিভারির শেষ মুহূর্তে আঙুল সামান্য রোল করেছিলেন লারসেন, লেংথ বল পিচ করে ভেতরে ঢোকে হালকা একটু। কিন্তু ক্লুজনারের ব্যাট-প্যাডের মাঝে ফাঁক ছিল বিশাল – বোল্ড!
কিপার অ্যাডাম প্যারোরো কিংবা স্বয়ং বোলার লারসেন, কারও যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, ৪ রানে বোল্ড ক্লুজনার। ধারাভাষ্যকক্ষে ব্যারি রিচার্ডস বলছিলেন, ‘দ্য ডেস্ট্রয়ার ইজ গন’ বা এরকম কিছু।, টানা ৯ ইনিংস অপরাজিত থাকার পর প্রথম আউট!
তাকে সেদিন তিনে নামানো নিয়ে নানা কথা ছড়িয়েছে পরে। একটি ছিল এরকম, ক্লুজনারের অপরাজেয় যাত্রা নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক হান্সি ক্রনিয়ের নাকি তা ভালো লাগছিল না। একজনকে নিয়ে এত মাতামাতি হওয়ায় দলের মূল ফোকাস নড়ে যাচ্ছিল।
ক্লুজনারকে আউট করতেই নাকি সেদিন তিনে পাঠান অধিনায়ক! এই তত্ত্ব বেশ বাজার পেয়েছিল তখন। তবে ক্রিকেটীয় যুক্তিও যথেষ্ট ছিল। গ্যারি কার্স্টেন ও হার্শেল গিবস সেদিন ১৭৬ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়েছিলেন। ৩৭ ওভার চলছিল। অমন শক্ত ভিত গড়ার পর রান রেট বাড়াতে ক্লুজনারকে তিনে নামানো স্বাভাবিকই।
এরপর তো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই অবিস্মরণীয় দুটি ম্যাচ। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে ২১ বলে ৩৬ করে আউট হলেন। পরে তার বোলিংয়েই গিবসের সেই ক্যাচ মিস, ধারাভাষ্যে টনি গ্রেগ যে ক্যাচকে বলেছিলেন, ‘লিটল ললিপপ।’ জীবন পেয়ে স্টিভ ওয়াহর অসাধারণ সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়ার জয়।
পরের ম্যাচ সেমি-ফাইনাল, আবার অপরাজিত ক্লুজনার, এবার ১৬ বলে ৩১। কিন্তু অনেকের মনেও থাকে না সেদিন ক্লুজনার আউট হননি। তার পাগলাটে দৌড় আর শেষ ব্যাটসম্যানের সেই রান আউট হয়ে গিয়েছে তার আজীবনের ট্র্যাজেডি! এই দুই ম্যাচ নিয়েই পরে অসংখ্য কথা-লেখা হয়েছে, আজ বলছি না।
ওই বিশ্বকাপের ক্লুজনার কী ছিলেন, পরিসংখ্যানে বা ভিডিও এখন আসলে পুরোটা ফুটিয়ে তুলতে পারবে না। জুলু ছাড়া যেন আর কিছু ছিল না ক্রিকেটে! সেই উন্মাদনার ধারণা খানিকটা পাওয়া যেতে পারে আজকের দিনে তার আউটটি থেকেই। মাত্র ৪ রানে বোল্ড হয়েছিলেন। কিন্তু ২১ বছর আগের দিনটায় ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল সম্ভবত সেটিই। ক্লুজনার আউট হয়েছেন!
– ফেসবুক থেকে