হ্যালো, হ্যারি পটার!

নতুন বছরের প্রথম মাসটা প্রায় শেষের পথে। ক’দিন বাদে ছেলেটার জন্মদিন। এই বছর ছেলেটা আঠারোয় পড়বে। ছেলেটাকে ‘সারপ্রাইজ গিফট’ কি দেয়া যায়, ভাবছিলেন রেনজো। হ্যামিল্টনের পথে তিনি, সেখানে এক কনফারেন্স আছে। বসন্তের এই সময়টা ঘর ছেড়ে, স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে, আসতে ইচ্ছে হয় না। তবুও কাজ বলে কথা, না-গিয়ে উপায় কি!

নিজেই ড্রাইভ করেন রেনজো। ফোনটা বেজে উঠতেই দেখেন, অকল্যান্ডের বাড়ি থেকে স্ত্রী রুবীন ফোন দিয়েছেন। ফোনে স্ত্রী যা বললেন তার জন্য কিছুতেই প্রস্তুত ছিলেন না রেনজো! বলে কি, তাঁর পুঁচকে ছেলেটা নাকি ডাক পেয়েছে নিউজিল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলে। বিশ্বাস করা যায়! অবিশ্বাস্য এক খবরে মাথাটা একটু দুলে উঠে রেনজোর। গাড়ীটাকে রাস্তার একপাশে থামান তিনি।

তাঁর ছেলে ড্যানিয়েল লুকা ভেট্টোরি, তাঁদের আদরের ‘লুকা’ খেলবে নিউজিল্যান্ডের হয়ে! ক’দিন আগেই না ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে ভর্তি হলো! বড় ফার্মাসিস্ট হবে, বড় ডিগ্রী নেবে, আর কোত্থেকে কি! ছেলের আঠারোতম জন্মদিনের ‘সারপ্রাইজ গিফট’ নিয়ে ভাবছিলেন রেনজো, নিজেই যে এমন সারপ্রাইজড হয়ে যাবেন, কে জানতো!

১৯৯৭ সালে অভিষেক টেস্ট যখন খেলতে নামছেন, তাঁর মুখাবয়ব জুড়ে লালচে আভা। যেন গোধূলি বেলার সূর্য তার সবটুকু লালিমা এঁকে দিয়েছে তাঁর লম্বাটে মুখটায়। চোখের উপর ইয়া মোটা চশমা। অল্প বয়সেই রাজ্যের সব জ্ঞান যেন অর্জন করে বসেছেন তিনি। বাবা রেনজো ভেট্টোরি যেমন ওয়েলিংটনের সেই প্রথম টেস্টের স্মৃতি মনে করে বলেছিলেন, ‘আমার মনে আছে ওর প্রথম টেস্টের সময় আমি দু’হাতে দুটি কাপ নিয়ে বসেছিলাম। প্রচন্ড উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছি। অথচ ওকে দেখলাম, আশ্চর্য্য শান্ত ভঙ্গিমায়, মাঠে প্রবেশ করছে।’

তিনি এমনই। শান্ত, সৌম্য, নির্লিপ্ত। ভাবুক, উদাসীন, পরিণত।

শুরুটা হয়েছিল নাসের হুসেইনকে দিয়ে। ইয়াংয়ের ক্যাচ বানিয়ে নাসেরকে ফিরিয়েছিলেন আঠারো বছরের ছোট্ট ভেট্টোরি। আর শেষটা টেনেছিলেন শারজায়, তালহাকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে। প্রথম টেস্টের মতো শেষ টেস্টেও ঠিকই এক রাঘব বোয়াল শিকার করেছিলেন তিনি। শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ইউনুস খানকে যে আউট করেছিলেন।

সাদা পোষাক তুলে রেখেছিলেন তারও বছর দুয়েক আগে। কিন্তু দেশ মাতৃকার ডাকে ধূলো ঝেড়ে সেবার আবার শুভ্র পোষাকটা গায়ে তুলেছিলেন শুভ্র চরিত্রের তিনি।

পরপর দু’বার তাকে সেমিফাইনাল থেকে বিদায়ের যন্ত্রনা দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। ঘরের মাঠে, অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে, দক্ষিন আফ্রিকাকে সেই একই যন্ত্রণা দিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু ক্লার্কের নিষ্ঠুর অস্ট্রেলিয়া তাকে বিশ্বমঞ্চ থেকে বিদায় দিয়েছিল, শূণ্য হাতে। রঙিন পোষাকে সেটাই ছিল তাঁর শেষ ম্যাচ। তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আঠারো বছরের পথচলার সমাপ্তিও ঘটেছিল সেখানেই।

ভেট্টোরির বাবা রেনজো ইটালিয়ান। আর মা রুবীন নিউজিল্যান্ডার। ইটালির নেপলসে আছেন তাঁর দাদী, সুযোগ পেলেই সেখানে ছুটে যান তিনি।

ছেলেবেলায় ফুটবল, ক্রিকেট দুটোই সমান ভালোবাসতেন। পনেরো বছর বয়সে এক বাস-দূর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে ফুটবল খেলার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তখন থেকে সব মনযোগ ক্রিকেটেই ঢেলে দেন। ক্রিকেটে শুরুতে ছিলেন মিডিয়াম পেসার। কিন্তু সেন্ট পল কলেজিয়েট স্কুলের এক শিক্ষকের পরামর্শে শুরু করেন বাঁহাতি স্পিন। আর তাতেই তাঁর বাজিমাৎ।

বাঁ-হাতি স্পিনে তাঁর চেয়ে বেশি উইকেট নেই আর কারও। সেই শিক্ষকের প্রতি নিশ্চয় কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তাঁর। ৩০০ উইকেট আর ৩০০০ রানের ডাবল ছুঁয়েছেন তিনি, অল্পের জন্য মিস করে গেছেন ৪০০০ রান আর ৪০০ উইকেটের ডাবল। যেখানে আছেন কেবল কপিল দেব।

লেন্সের বদলে চশমা ব্যবহারেই স্বচ্ছন্দ্য তিনি। ‘আমি খুব ছোটবেলা থেকেই এটাতে অভ্যস্ত। তাছাড়া যদি এটা (চশমা) না থাকত, তাহলে হয়তো লোকে আমাকে কম মনে রাখত।’, চশমা ব্যবহারের ব্যাখ্যা জানিয়েছিলেন ড্যান।

২০০০ সালে, অকল্যান্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই ইনিংসে পেয়েছিলেন বারো উইকেট। তাঁর প্রথম ‘দশ উইকেট’ প্রাপ্তি। সেই টেস্টেই একশ টেস্ট উইকেট নিয়ে সবচেয়ে কম বয়সে শততম উইকেট শিকারের রেকর্ড করেছিলেন। বোলার থেকে একসময় অলরাউন্ডার হয়ে উঠেছিলেন। সাকিব আল হাসান ও জ্যাক ক্যালিসদের সাথে ব্যাটে-বলে পাল্লাও দিয়েছিলেন সমানতালে।

নেতৃত্বের ভারও সামলেছিলেন সুনিপুণ দক্ষতায়। ‘নেতৃত্ব হচ্ছে এমন একটা ব্যাপার, যেখানে আপনাকে সামনে থেকে পারফর্ম করতে হবে। আর আমি সবসময় সামনে থেকে পারফর্ম করতে চেয়েছি।’, বলেছিলেন ভেট্টোরী। শুধু বলেই ক্ষ্যান্তি দেননি, করেও দেখিয়েছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে তাই ব্যাটিং গড়ে পূর্বসূরী ফ্লেমিংকেও অনায়াসে পেছন ফেলেছেন তিনি।

প্রথম টেস্টে ব্যাট করেছিলেন এগারো নম্বরে। পরবর্তীতে ওপেনিং বাদে বাকী সব পজিশনেই ব্যাট করেছেন তিনি। আট ও নয় নাম্বারে ব্যাট করে সবচেয়ে বেশি রানও তাঁর।

২০০৩-২০০৪ এ ব্যাটিংয়ে উন্নতি করলেও বোলিংয়ে দুঃস্বপ্নের মতো এক সময় কাটিয়েছিলেন। এই সময়টাতে ব্যাটিং গড় চল্লিশ পেরোলেও, বোলিং গড় ৭৫ ছাড়িয়েছিল। একটি উইকেটের জন্য ব্যয় করতে হচ্ছিল ১৬৩ বল! সেই দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠতেই অন্য এক ভেট্টোরীর আবির্ভাব ঘটেছিল যেন!

পরের সময়টাতে ব্যাটিং-ধারাবাহিকতায় গড় পৌছে গিয়েছিল ত্রিশের কোটায়। আর বোলিংয়েও নিয়ে এসেছিলেন দারুণ নিয়ন্ত্রণ। ব্যাটে-বলে মিলিয়ে হয়ে উঠেছিলেন সমান কার্যকর। শুধুই কি ব্যাটে-বলে? কোচ হিসেবে, নির্বাচক হিসেবেও যে ভেট্টোরি কার্যকারীতার প্রমাণ দিচ্ছিলেন।

২০০৯ সালে অ্যান্ডি মোলস যখন পদচ্যুত হলেন, তখন তাকে সাময়িকভাবে কোচিংয়ের দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। একই সাথে ছিলেন নির্বাচকও।

স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের পর দ্বিতীয় নিউজিল্যান্ডার হিসেবে খেলেছিলেন শততম টেস্ট। নিউজিল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশী টেস্ট খেলার রেকর্ডটাও তাঁর।

তাঁর শততম টেস্টটিও মাঠে বসে দেখেছিলেন তাঁর বাবা-মা, ঠিক প্রথম টেস্টটির মতো। গ্যালারিতে ছিলেন তাঁরা পঞ্চাশতম টেস্টে, ছিলেন শেষ টেস্টেও। ছেলে ড্যানের খেলা দেখার জন্য তাঁরা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, দুবাই সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন। ছেলের খেলা দেখতে দেখতে ১২টি স্ক্র্যাপবুকও তৈরী করে ফেলেছেন বাবা। কি হবে এগুলো দিয়ে? ‘তাঁর বাচ্চারা দেখবে, হয়তো ড্যানের নাতি-পুতিরা দেখবে।’ হাসতে হাসতে জবাব দেন রেনজো ভেট্টোরি।

পুত্র গর্বের চেয়ে বড় গর্ব আর কী হতে পারে? রেনজো ভেট্টোরি ও রুবিন ভেট্টোরি সেই গর্ব তাই বড় আকুল হয়ে উপভোগ করেন।

তাঁদের আদরের ধন, হাঁটি হাঁটি পা পা ছেড়ে, মহীরুহ হয়েছেন বহু আগেই। অমরত্বের পথে যাত্রা আরো সুনিশ্চিত করতেই হয়তো মনোনিবেশ করেছেন কোচিংয়ে।

বাঁ-হাতের জাদুকর, তাঁর হাতটাকে বিশ্রাম দিয়ে, এখন মস্তিষ্ক দিয়েই খেলবেন হয়তো। কে জানে সেই মস্তিষ্ক থেকে কি আশ্চর্য্য-কৌশল বের করে আনবেন তিনি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link