লেটস ট্রাই মাহি!

আইসিসি সিদ্ধান্ত নিল ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের একটি বিশ্বকাপ হবে। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসর। তবে হঠাত করেই বেঁকে বসে ভারত। তারা এই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে চায় না।

পরে জানা যায়, সেই সময়ে ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলিরা এই আসরে খেলতে চান না। শেষ পর্যন্ত আইসিসির জোরাজুরিতে ভারত একটি দ্বিতীয় সারির দল দাঁড় করালো এবং গ্রেট শচীনের পরামর্শে একটা নতুন ছেলেকে অধিনায়ক করা হলো সেই দলটার। যেই অধিনায়ক পরবর্তীকালে ভারতের ক্রিকেট তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটে তাঁর দাগ রেখে যাবেন।

২০০৪ সালের সৌরভ গাঙ্গুলির ভারত দলে বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা সব ব্যাটসম্যানরা। সেই দলে কোনো নতুন ব্যাটসম্যানের দলে জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে একজন ভালো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল ভারত। বেশ কয়েকজন কিপার ব্যাটসম্যানকে ভারত সেই সময় দলে পরীক্ষা করে দেখেছিল। এমন কি স্বয়ং রাহুল দ্রাবিড়কে দিয়ে অনেকদিন এই কাজটা সামলেছে ভারত!

তবে তাঁদের কেউই লম্বা সময়ের জন্য দলে জায়গা করে নিতে পারেননি। যদিও একটা ছেলের নাম অনেকদিন ধরেই ঘুরে ফিরে আসছিল। দ্রুত রান তুলতে পারে, উইকেটরক্ষক হিসেবেও ভালো। তবে কিপিং বা ব্যাটিং কোনোটাই টেকনিকালি স্ট্রং না। সেজন্যই তাঁকে দলে নেয়া হচ্ছিল না। তবে এবার সৌরভ আরেকবার সাহস দেখালেন। বাংলাদেশ সফরের আগে নির্বাচকদের সাথে এক মিটিং এ দাদা বললেন, ‘লেটস ট্রাই মাহি।’ এই জুয়াটা দাদার চেয়ে ভাল কেই বা খেলতে জানেন!

তবে বাংলাদেশের সাথে অভিষেক ম্যাচের শূন্য রানে রান-আউট হয়ে ফেরেন মাহি। সিরিজের পরের দুই ম্যাচে মাহির সংগ্রহ ১২ ও ৭ রান। তিন ম্যাচের সিরিজে ১৯ রান করা মাহি পরের পাকিস্তান সফরে দলের সঙ্গে থাকবেন কিনা সেটাই তখন বড় প্রশ্ন। তবে ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক সৌরভ আস্থা রাখলেন। মাহি সেই আস্থার এমনই প্রতিদান দেন যে এক সময় ভারতের চায়ের দোকানের আড্ডায় তর্ক হয় তাঁদের নিয়ে। ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক কে- সৌরভ নাকি মাহি?

পাকিস্তানের সাথে ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে মাহি তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করলেন। তাঁর সেই ১২৩ বলে ১৪৮ রানের ইনিংসটি পরবর্তীকালে মাহি ও ভারতের ক্রিকেটের অনেক সমীকরণ মিলিয়ে দিবে। ২০০৫-০৬ সালে আরো কিছু স্বভাবসুলভ দ্রুত গতির ইনিংস খেলেন তিনি।

ফলে ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য কোনো সিনিয়র  ক্রিকেটারকে না পেয়ে দ্বিতীয় সারির দলটির  অধিনায়ক ঘোষণা করা হলো মাহিকে। বিশ্বকাপ খেলতে গেলো ভারতের একটি তরুণ দল, যেই দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি।

সেই বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় অধিনায়ক ধোনির যাত্রা। একটা তরুণ দল নিয়ে প্রথমাবারের মত অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পেয়েই ভারতকে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে ফেললেন ধোনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে শেষ ওভারে যখন পাকিস্তানের ১৩ রান প্রয়োজন তখন কেনো পার্টটাইম বোলার জোগিন্দার শর্মার হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা হয়তো শুধু ধোনিই দিতে পারবেন। তবে সেদিন শর্মা বল হাতে ভারতকে জিতিয়ে দিয়েছিল। ক্যাপ্টেন ধোনির আরো এমন কিছু সিদ্ধান্ত ভারতকে বানিয়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।

ভারতকে সেবার শুধু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নই বানাননি ধোনি। ধোনির এই তরুণ দলটাকে দেখে সেই সময়ই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ছক করেন ললিত মোদি। যেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ এখন পুরো বিশ্বক্রিকেটের চেহারাই পাল্টে  দিচ্ছে।

বিশ্বকাপ জয়ের পরপরই বেশ হুট করে ভারতের ওয়ানডে দলের অধিনায়ক বনে যান ধোনি। হুট করে হয়ে যান বলার কারণ হলো ঠিক সেই সময় সৌরভ, অনিল কুম্বলেদের অবসরের পর দলটার হাল ধরার মত কাউকে পাচ্ছিল না ভারত। শচীন,দ্রাবিড়রা আবারো বললেন, ‘লেটস ট্রাই মাহি।’ তারপর খুব দ্রুত সময়ের ব্যাবধানে ওয়ানডে ও টেস্ট অধিনায়কত্ব পায় ধোনি।

ওয়ানডে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর থেকেই ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রতি নজর দেন তিনি। সেই সময় ভারতের ক্রিকেটের জন্য কিছু কঠিন সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন তিনি। সেই সময়ের ভারতের তিন সিনিয়র ক্রিকেটারকে তাঁদের ফিটনেসের জন্য দলের বাইরে রাখার কথাও বলেন তিনি। এই নিয়ে তখন ভারতীয় ক্রিকেটে ,মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় হয়ে গেলেও ধোনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন। তাঁর নেতৃত্বে ২০১০ সালে এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত।

ধোনির তিন বছরের পরিকল্পনায় গড়ে তোলা ভারত এবার ঘরের মাঠে খেলতে নামে ২০১১ বিশ্বকাপ। পুরো বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে খুব একটা ভালো সময় না কাটালেও ধোনির অধিনাকত্বেই ফাইনালে ওঠে ভারত। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে অফ ফর্মে থাকা ধোনি নিজের ব্যাটিং অর্ডার উপরে নিয়ে আসেন এবং দলকে চ্যাম্পিয়ন করেই মাঠ ছাড়েন।

ভারতীয় ক্রিকেটে তিনি ‘আউটসাইডার’। ভারতের তিনি ‘অ্যাক্সিডেন্টাল’ অধিনায়ক। তবে, সব কিছু ছাপিয়ে ধোনি থাকবেন ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়কত্বের তর্কে, মাহি থাকবেন ফাইনালের সেই ছক্কায় কিংবা এক নতুন ভারতের গল্পে, নতুন বিশ্ব ক্রিকেটের রূপরেখায়।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link