পঞ্জিকার পাতা বলছে সবে অগ্রহায়নের শুরু হয়েছে। শীত আসি আসি করলেও কাঁপাকাঁপি শুরু হতে এখনও দেরী আছে। কিন্তু ফেসবুক থেকে শুরু করে অলিগলি, অট্টালিকার ছাদ থেকে শুরু করে গাছের ডাল; সব জায়গার ছবি বলছে, মানুষ কাঁপতে শুরু করেছে।
এই কাপুনি শীতের নয়; বিশ্বকাপের।
হ্যাঁ, ফিফা বিশ্বকাপ। কারও কারও মতে গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ। চার বছর ঘুরে আবার চলে এসেছে বিশ্বকাপ। আর কয়েক ঘন্টা পরই পর্দা উঠবে কাতার বিশ্বকাপের। এই সময়টা কেবলই বিশ্বকাপের জ্বরে কেঁপে কেঁপে ওঠার সময়। এখন আর অন্য কোনো কথা নয়, কেবলই বিশ্বকাপের কথা; মেসি-রোনালদো-নেইমারের কথা। এখন কেবলই উৎসব করার সময়।
হ্যাঁ, অনেক নেতিবাচক আলোচনা আছে। কাতার বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে বিতর্কের আলোচনা আছে। ফিফার দুর্নীতির কথা আছে। আছে কাতারে শ্রমিকদের সাথে নিষ্ঠুরতার কথা। অনেক কিছুই চাইলে বলা যায়। কিন্তু দিনশেষে সব বিতর্ক আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। এখন শত কথা বলেও অবস্থা আর বদলাবে না। এখন তাই কেবলই বিশ্বকাপে মেতে ওঠার সময়।
আমাদের দেশেও তো কত কথা হয়।
এই জার্সি, পতাকা না কিনে সেই টাকা অসহায় একটা মানুষের হাতে দিলে উপকার হত-এমন হঠাৎ মানবতাবাদীদের খুব উত্থান হয়েছে। এই অথর্বরা জানেই না যে, এই জার্সি, পতাকার উন্মাদনা মানে এক ধরণের অসহায়, খেটে খাওয়া মানুষের দু পয়সা ইনকামের সুযোগ। এই উন্মাদনা আছে বলেই বাংলাদেশের শত শত দর্জি, কাপড় ব্যবসায়ী এই মৌসুমে কয়েক মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা ভাগ করতে পারছেন। এটা বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের জন্য যে আশীর্বাদ, অর্থনীতির এই সামান্য বোধটুকু তাদের নেই।
তাদের বরং প্রশ্ন করুন, আপনি জার্সি বা পতাকার টাকা বাঁচিয়ে কত জনকে সাহায্য করলেন? উত্তর পাবেন না। কারণ, এত মিথ্যে তারা বলতে পারবে না। এসব হঠাৎ চাগাল দিয়ে ওঠা মানুষতে পাত্তা দেবেন না।
এদের চুপষে দেওয়াটা খুব সোজা; স্রেফ জিজ্ঞেস করুন-আপনি তো আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল করেন না, অপকামে সময় নষ্ট করেন না; এই সময় ও অর্থগুলো দেশের কী কী কাজে লাগিয়েছেন?
এরা এত বড় ক্ষমতাধর চাপাবাজ না যে, নিজের সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে কিছু তথ্য জানাবে।
ভাবছেন, এদের অক্ষমতা ও অপদার্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম কী করে? কারণ সোজা, যারা এই প্রতি পদে আপামর মানুষের খুত ধরে বেড়ানোর মত সিনিক পাব্লিক, এদের আসলে ভাল কিছু করার টাইমই নাই। ভাল-খারাপ কিছুই তারা করে না, স্রেফ একটা আঙুল বাঁকা করে ঘুরে বেড়ায়।
সারা বছর এদের আপনি প্রতিটি সময় পাবেন।
রানা প্লাজা ধ্বসে যখন সারা শহরের ছেলে-মেয়েরা খেটে মরছে, এরা তখন বলছে, ‘অমুকের টাকা নিচ্ছেন কেন? ওতো দেশপ্রেমী না। ওর টাকা নিলে মানুষের আত্মা শান্তি পাবে না।’
রাগ সঙ্গীত সম্মেলন হলে বলে, ‘ইস, টাকা দিয়ে আ আ করে অপচয় হচ্ছে।’
বামবা কনসার্ট হলে বলে, ‘টাকা খরচ করে গাজা খাচ্ছে লোকেরা। এই টাকায় মানুষের সেবা করা যেত।’
ছেলেরা হন্ডুরাস নিয়ে মাতামাতি করলে এরা বলে, ‘ইস এতে দেশের জিডিপি বাড়ছে না, তাহলে কিসের হন্ডুরাসপ্রেম!’
আবার এই পাপমনস্ক মানুষগুলো উঠে পড়ে লেগেছে মানুষের পেছনে- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল করে সব গোল্লায় গেল। এতে দেশের সর্বনাশ হয়ে গেল। এ না করে এরা যদি ফুটবলের কাজ করত!
কেউ কী উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে এসে এসব করছে নাকি? যে গান গায়, কাজ করতে করতেই খায়। যে কাজ করে না, তার কাজ না করার কারণ হিসেবে গান লাগে না; সে এমনিই কাজ করে না।
মূলত এই সেবা, উন্নয়ন; কিছুই এসব মানুষের আসল ভাবনা নয়। আসল ভাবনা হল, বিপরীত কিছু বলে আলোচনায় থাকা এবং মানুষের আনন্দ সইতে না পারা। মানুষ হিসেবে এরা হল স্যাডিস্ট। কোনো কিছুতে আনন্দ পায় না, উৎসব খুঁজে পায় না। নিজের এই না পাওয়াটা এরা ছড়িয়ে দিতে চায় মানুষের মধ্যে। নিজের নেতিবাচকতা, বিষন্নতা মহামারী হয়ে উঠুক; এই হল প্রার্থনা।
কথায় কথায় এরা বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতির অভিযোগ করবে। বলবে, পৃথিবীর কোথাও এমন হয় না।
কোথাও না হলে ক্ষতি কী? কেউ না করলে এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্য হিসেবে আরও বুক ফোলানোর মত ব্যাপার হয়। জোর গলায় তখন আমরা বলতে পারি, আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বিশ্বকাপ নিয়ে মাততে পারি; এ আমাদের পারার ব্যাপার।
যে ছেলেটা এখন আর্জেন্টিনা নিয়ে মাতছে, করোনার সময় মানুষের জন্য রাস্তায় নেমেছে। যে মেয়েটা আজ ব্রাজিল নিয়ে মেতেছে, সেই বন্যার সময় দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে মানুষের জন্য ভিক্ষা করেছে। যে ছেলেটা ব্রাজিল নিয়ে মাতছে, সেই ফেসবুকে গ্রুপ করে ফুটবল মাঠে বন্ধুদের ডেকে আনছে। এরাই রাস্তায় বাচ্চাদের পড়ায়, এরাই রানা প্লাজায় ছোটে, এরাই বাচ্চাদের আম খাওয়ায়, এরাই শীত বস্ত্র সংগ্রহ করে এবং এরাই বিশ্বকাপ এলে পাড়া মাথায় করে; আমি জেনে বলছি। যারা করে, তারা সবগুলোই করে।
যারা বলে, এটা না করে ওটা করো; তারা এটা-ওটা কোনোটাই করে না।
বিশ্বকাপের সময় আমরা বিশ্বের একজন হব; কোনো জ্ঞানের ধার ধারি না।
বিশ্বকাপ আমাদের নির্মল বিনোদনের উৎসব। জানি কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করে ফেলবে। তারপরও এটাই সত্যি যে, বাংলাদেশের এখন একমাত্র সার্বজনীন উৎসব এই বিশ্বকাপ। সকলে মিলে এখানে আমরা বিনা স্বার্থে ঝগড়া করি। এই বিনা স্বার্থে মেতে উঠতে পারাটা অনেক বড় একটা ব্যাপার।
এই উৎসবের সময় কাউকে পাত্তা দেবো না আমরা। কেবল বলবো-
‘আয় বিশ্বকাপ ঝেঁপে, ধান দেব মেপে!’