১.
ওয়ান্ডারার্সের ড্রেসিংরুমে তখন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছেন কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। চোয়াল চওড়া করা হাসি বেরোচ্ছে অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়ের মুখ চিড়ে, শ্যাম্পেনের ফোয়ারাতে সেলিব্রেশন জহির-শচীন-ওয়াসিম জাফরদের। পরের দিন খবরের কাগজের প্রথম পাতাতেই একটা হাতের ছবি বেরোলো।
ছবিটা এমন ছিল যে হাতের দুটো আঙুল সিম পজিশন করে আছে একটা লাল বলের ওপর, আর উপরের হেডলাইনে লেখা – ‘সোনার হাত’। দক্ষিণ আফ্রিকার সবুজ প্রান্তের অনাবিল স্যুইং আর গতির সাম্রাজ্যে এক নতুন বহ্নিশিখার আবির্ভাব। একটা সাদামাটা শুরুর পরেও কেরালার উড়ন্ত কেতন ফালাফালা করে সেবার চিড়ে দিয়েছিল গ্রায়েম স্মিথ-পোলক-আন্দ্রে নেল-অ্যাশওয়েল প্রিন্স-ক্যালিসদের। মাথায় একটা সাদা পট্টি বেঁধে একটা সোনার হাতের স্যুইং অঘোষিত ঘোষণা করেছিল – ‘I can Smell Blood’।
২.
ক্রিজে আসতে আসতে আন্দ্রে নেল প্রথম ইনিংসের ক্যাম্বিস-নায়ককে বলেই ফেললেন, ‘You Rabbit, I will get you in the next ball।’ বাউচারকে ঈশারা করলেন শর্ট লেগে ফিল্ডার দেবার জন্য। উইলোধারী ফাস্ট বোলারটি পড়ে ফেলেছিল মাথাভাঙা বাউন্সারের ঈশারা। বাউন্সার এল-ব্যাট ঘোরালেন-লম্বা ছয়।
আর তারপর যেটা করলেন সেটা রীতিমত ব্রেকড্যান্স, আর আন্দ্রে নেলের দিকে বলে চলা কিছু খুনে শব্দব্রহ্ম।পরে জিজ্ঞেস করা হয় যখন ঠিক কি বলেছিলেন, জানা যায়, ‘How was the Slap, Nel?’
একঝাঁক আভিজাত্যের সাদা পোশাকের মাঝে, এক রঙিন তুর্কির জন্ম।খবরের কাগজের সেই ‘সোনার হাত’ হেডলাইনটির একছত্র মালিক – শান্তাকুমারান শ্রীশান্ত। সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ১৮ উইকেট, কুম্বলের রেকর্ড স্পর্শ। আরপি সিং এর পর রাহুল দ্রাবিড়ের হাত ধরে আরও এক ফোঁটা রক্তের আমদানি পেস ব্রিগেডে।
মেকি ভদ্রতার পোশাক খুলে আগ্রাসনের প্রতীক বেয়ে চলা এক কেরালাবাসী, মিডিয়াখ্যাত ‘অভদ্র বোলার। জীবনটাতে শুধুই স্পট লাইট এবং স্পট লাইট। অর্ধেক জীবন ফেলে এসেছেন ২২ গজে, আর বাকি গজগুলো লাইন দিয়ে এখনো ইউটিউবে সাজানো আছে বিভিন্ন বিতর্কমূলক ঘটনার অঙ্গনে অঙ্গনে।
আমি যে সময়টার কথা বলছি সে সময়ে বিরাট কোহলির আগ্রাসনের আগমন হয়নি,আবার সৌরভ গাঙ্গুলির স্পর্ধাকেও অকাল অবসরে পাঠানো হয়েছে।ভারতের টিমে তখন এক ঝাঁক শান্ত বটগাছ-দ্রাবিড়, কুম্বলে, লক্ষ্মণ। সেই শান্ত ভারত মহাসাগরে একটা ছোট পাঁচ বছরের জীবন নিয়ে আগমন ঘটেছিল হাওয়ায় ভেসে চলা ঢেউয়ের।
কোহলির অনেক আগেই এক ভারতীয় অচেনা পেসার জবাবের বিরুদ্ধে জবাব দিয়েছিল,,হরভজনের মাঙ্কিগেটসের অনেক আগেই কোঁকরা চুলের এক ‘এল ম্যাটাডোর’ ভেঙচি কেটেছিল সাইমন্ডসকে। আমাদের স্কুল জীবনে এভাবেই ঝটিকা সফরে এসেছিল সে, জহির খান আর ডেল স্টেইনের উপর থেকে স্পট লাইট কেড়ে নিয়ে সিরিজে ১৮ টা উইকেট নিয়ে অন্ধকার মহাদেশের ব্যাটিং লাইন আপের অযাচিত ধ্বংসের কেতনবাহক একজন শ্রীশান্ত।
একটা নতুন মশলা, স্বাদ মোটামুটি, কিন্তু ঝাঁঝ খুব, যে বোঝে রক্তের গন্ধটা। সেই ২০০৭ এর নস্টালজিক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেমিফাইনালে প্রথমে সেট হওয়া গিলক্রিস্টের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিয়ে সেই স্বভাবসিদ্ধ দাঁত খিঁচুনি,মেকি সভ্যতার আড়াল থেকে উঠে এসে ঝিমানো ভারতবাসীকে রক্তের স্বাদ বোঝানো ওয়াসিম আকরামের এক ছাত্র।
আর তারপর ম্যাচ আস্তে আস্তে কেড়ে নেওয়া ম্যাথু হেডেনের অফস্ট্যাম্প ছিটকে দিয়ে সেই মাটির পিচে দু হাত চাপড়ে সেলিব্রেশন। পাড়ার ক্রিকেটে ওই সেলিব্রেশনটা কতবার যে অনুকরণ করেছি,ইয়ত্তা নেই। আমরা ক্লাসে বলতাম – ‘এল ম্যাটাডোর’ – মানে ‘খুনে স্ট্রাইকার’ যেটা বলা হত আর্জেন্টিনার মারিও কেম্পেসকে।
পাঁচ বছরের একটা ছোট্ট স্পেল, ইউটিউব ভর্তি করা মুহুর্ত আর তারপর ওল্ড ওয়াইন হবার অনেক আগেই আস্তে আস্তে হারিয়ে যাওয়া এক প্রাণচঞ্চল কেরালাবাসী। স্বপ্ন ছিল যার লেগ স্পিনার, অনিল কুম্বলের বোলিং অ্যাকশনের ভক্ত আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের নতুন রক্তের খাজাঞ্চিবাবু। সাদামাটা বোলিং লাইনে অ্যাগ্রেসনের স্পর্ধা। এক ঝাঁক বিতর্কের সম্রাট – হরভজনের হাতে চড়, স্লেজিংয়ে বারবার সাসপেনশন, আর অবশেষে সেই বিতর্কিত স্পট ফিক্সিং, তারপর শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার।
২০১১ বিশ্বকাপের পর একটা অনুষ্ঠানে বিশ্বকাপজয়ী টিমকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিল। একে একে সবার নাম নেওয়া হচ্ছিল। বেমালুম ভুলে গেল তার নামটা। শচীন শেষমেশ সবাইকে মনে করালেন তার নামটা। কিছুদিন পর কাঁদতে কাঁদতে সাক্ষাৎকারে শ্রীশান্ত বলেছিলেন – ‘Sachin prompted my name, and I cried a lot.’
শতবর্ষের বোলিং সাম্রাজ্যের কালো চ্যাপ্টারে হয়তো শান্তাকুমারন শ্রীশান্ত নামটা হাইলাইট করা থাকবে,তবুও কেউ তো এসেছিল যে নুইয়ে পড়া বোলিং লাইন আপটায় স্লেজিংয়ের স্পর্ধা জুগিয়েছিল, কেউ তো ছোট্ট একটা বিতর্কিত স্পেলে ধ্বজা উড়িয়েছিল যে বিদেশিদের স্লেজিং ছোঁড়া বাউন্সারের প্রত্যাঘাতে বলতে পেরেছিল, ‘How was The slap?’
স্পট ফিক্সিং এর ঘৃণাভরা অভিসম্পাত মাথায় নিয়ে করা, অভদ্রতা আখ্যানে কলুষিত করা নামটা হাজার বছর ধরে ব্ল্যাক লিস্টে থাকবে এই মেকি সভ্যতার বইয়ে। আর আমরা কিছুজন থাকব যারা অপেক্ষাকরত ব্যাগি গ্রিনদের বিরুদ্ধে কখন ধেয়ে আসবে সেই দাঁতখিচানো স্লেজিং, কখন ভাঙবে হেইডেন-গিলক্রিস্টের অফ স্ট্যাম্পটা।
তথাপি মেকি এ সভ্যতায় কুলের দিকে ভিড়তে চাওয়া একটা দিকভ্রষ্ট জাহাজকে আমরা লাল পতাকা দেখিয়ে সঠিক কুলের ঠিকানা পাঠাইনা,,বরং পাঠিয়ে দিই ঘৃণ্য শ্লেষের তীরগুলো…এটাই কি তবে সভ্যতা যেখানে ভুলের ক্ষমা নেই? পথ হারানো পথিকের ফেরার রাস্তা নেই? দিকভ্রষ্ট জাহাজটিকে লাল পতাকা দেখানোর লোক নেই! হেইডেন-গিলির স্টাম্পটা হয়তো ভেঙেছিল, ভাঙেনি আমাদের মেকিত্বটা।
কেটে গেছে অনেকদিন। ফেলে দেওয়া গাছে আবারও গোলাপ ফুটতে চাইছে। দিকভ্রষ্ট নাবিক যখন আবারো জাহাজটাকে তীরে ভেড়াতে চায়,তখন কেউ তো থাকে যে E-N-W-S লেখা চুম্বকখন্ডটিকে তুলে ধরে সেই নাবিকটির সামনে।
‘ডিপ্রেশন’ নামক পর্যায় সারণীতে আরও এক অণু হতাশা যোগ হবার আগেই, সময় থাকতে থাকতে আসুন না আমরা টেনে তুলে ধরি তাঁর হাতদুটোকে। আসুন না হাতকড়ার বদলে ফুলমাল্য পরিয়ে স্বাগত করি ওয়ান্ডারার্সের সেই সোনার হাতদুটোকে। তাহলে কোনো একদিন হয়তো বলতে পারব আমরা একজন সুশান্তকে যেতে দিয়েছিলাম, কিন্তু টেনে ধরেছিলাম একজন শ্রীশান্তের হাতদুটোকে।
অবশ্য যে দেশে একজন নিরপরাধ ধর্ষিতা নারীকে ফেরার পথ না গড়ে দিয়ে আমরা তাদের দিকে আড়চোখ ভাঁজি সে দেশে আমরা একজন শ্রীশান্তের জন্য হাত বাড়াবো সেটা ভাবা হয়তো আমার অলীক কল্পনা। তবুও এখনও বিশ্বাস রেখে আপনাদের কাছে আজ দাবি জানালাম, আসুন না একটা সভ্যতা গড়ি যেখানে হাত বাড়ালেই বন্ধু পাওয়া যাবে। ডিপ্রেশনের পর্যায় সারণীতে আরও এক অণু হতাশা যোগ হবার আগেই।
ভেঙে পড়া টাইটানিকটাকে জুড়তে আমরা না হয় দিকনির্দেশক কলম্বাস হলাম, ক্ষতি কি!