বিদ্যুৎ চমকানো আকাশে আচমকাই কোন মন্ত্রবলে বিদ্যুৎ চমকানো বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছেন কোনদিন?
আমি দেখেছিলাম বছর এগারো আগে। তবে আকাশে না, ক্রিকেটের মাঠে। শেন বন্ডের বলে তীব্র গতির চমক আচমকাই বন্ধ করে দিয়েছিল যে মন্ত্রবল, তার পোষাকী নাম ছিল চোট আঘাত প্রবণতা। এই গতিময় শেন বন্ডই ক্রিকেটে আসার আগে একসময় গতি নিয়ন্ত্রক ছিলেন। সেটা ১৯৯৯-এর কথা।
তখন তিনি এক তরুণ ট্রাফিক সার্জেন্ট হিসেবে ক্রাইস্টচার্চের রাজপথে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এবং শুরুর দিকে রোজ রোজ নতুন চাকরীতে ভুল দিকনির্দেশের মাশুল দিতেন আরোহীদের ছুঁড়ে দেওয়া ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মালা পরে।
তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন যে বছর দু’তিনের মধ্যেই তিনি নিজেই চড়ে বসবেন দেশের হয়ে ফাস্ট বোলিংয়ের গতির রথে? এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরো প্রথম দশক জুড়ে তার ডান হাতেই পরম নিশ্চিন্ততা খুঁজে পাবে কিউই বোলিং?
২০০১-০২ মৌসুমের অজি-কিউই-প্রোটিয়া ত্রিদেশীয় ভিবি সিরিজে সর্বোচ্চ ২১ উইকেট এবং ২০০২ সালে ভারতের নিউজিল্যান্ড সফরে ২ টেস্টে ১২ উইকেট নিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার আগমনবার্তা এবং থেকে যাবার সদিচ্ছা। হোল্ডিংয়ের পরে অত দৃষ্টিনন্দন নিখুঁত রান আপ প্রায় দেখিইনি, যার ফলশ্রুতি ছিল দুর্দান্ত গতিসম্পন্ন ডেলিভারি। কোনদিনই ব্যাট হাতে নিয়ে কিছু করার উৎসাহ পান নি তিনি, তবু তার টেস্টে আর ওডি আই-তে সর্বোচ্চ রান ছিল ৪১ আর ৩১।
সমউপাধির এক জেমস যেমন ‘ফাস্ট, ফিউরিয়াস আর ড্যাশিং’ হয়ে পেড়ে ফেলতেন তার পর্দা শত্রুদের, ঠিক সেভাবে ইনস্যুইং, আউটস্যুইং আর বলের গতি সম্বল করে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের নাকানিচুবানি খাওয়ানোই ছিল তার মিশন। প্রথম বোলার হিসেবে ঘন্টায় ১৫০ কিমি অতিক্রম করা বোলার ছিলেন তিনিই।
বারবার সার্জনের টেবিল পৌঁছে গিয়েও কোনদিন তিনি বলের গতির সঙ্গে আপোস করেন নি এবং সে কারণেই পৌনপুণিক চোটের গ্রাসে চলে গেছেন। যার ফলে অবসর নিয়েছেন, তা ভেঙ্গে ফিরেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, আবার চলে গেছেন চির অবসরে। তাইতো প্রায় ১০ বছরের পরিসরে তাঁর খেলা টেস্ট আর ওয়ানডের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮ আর ৮২।
২০০১ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর, ১৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলে তিনি নিয়েছিলেন ৮৭টি উইকেট, ২২.০৯ গড়ে। তার টেস্টে ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল ৫ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ছিল ১ বার, সেরা বোলিং ছিল ইনিংসে ৬/৫১ আর ম্যাচে ১০/৯৯।টেস্টে মোট ৮টি ক্যাচ নিয়েছিলেন তিনি।
আর ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ১৩ মার্চ, ৮৭টি ওডিআই ম্যাচ খেলে তিনি নিয়েছিলেন ১৪৭টি উইকেট, ২০.৮৮ গড়ে। তার ওডিআই-তে ৫ উইকেট ছিল ৪ বার, সেরা বোলিং ছিল ৬/১৯ আর ওয়ানডেতে মোট ১৫টি ক্যাচ নিয়েছিলেন তিনি। ওয়ানডেতে তৃতীয় দ্রুততম বোলার হিসেবে ১০০ উইকেটের মাইলস্টোন ছুঁয়েছিলেন তিনিই।
২০০৫ সালের ২১ অক্টোবর থেকে ২০১০ সালের ১০ মে, ২০ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে তিনি ২১.৭২ গড়ে নিয়েছিলেন ২৫ টি উইকেট, সেরা বোলিং ছিল ৩/১৮। টি-টোয়েন্টিতে ১৪ টি ক্যাচ নিয়েছিলেন তিনি। তার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রেকর্ডও ছিল বেশ ভালো, ৬০ ম্যাচে ২৪.৩৪ গড়ে ২২৫ উইকেট। প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে তার ইনিংসে ৫ উইকেট ছিল ১২ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ছিল ১ বার, সেরা বোলিং ছিল ৭/৬৬।
২০০৩ আর ২০০৭, দু’টি বিশ্বকাপ খেলে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৩০ উইকেট, যথাক্রমে ৮ ম্যাচে ১৭ উইকেট আর ৮ ম্যাচে ১৩ উইকেট।তার দশকে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে পড়তেন শচীন-রাহুল-সেওয়াগ-সৌরভ-যুবরাজ-কালিস-এবিডি-গিলক্রিস্ট-হেইডেন-পন্টিং-ওয়াহ-লারা-চন্দরপল-কেভিন পিটারসেন-ট্রেসকোথিক-বেল-কলিংউড-ইনজামাম-ইউনিস-মিসবাহ-মাহেলা-কুমার, এটা মনে রাখলে তার বোলিং গড়কে সম্ভ্রম করতেই হবে।
একটা সময় টানা ছয়বার তার শিকার হয়েছিলেন রিকি পন্টিং। বুলাওয়েতে সৌরভ-শেবাগ-দ্রাবিড় ব্যাটিং লাইনআপ নতজানু হয়েছিল তার ১৯/৬-এর কাছে। পোর্ট এলিজাবেথে অস্ট্রেলিয়া তার বোলিং বশীকরণে (৬/২৩) মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিল।
গতিরথের শীর্ষ সম্ভাবনাকে অপরিণত অবস্থায় দুমড়ে মুচড়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি পিঠ, হাঁটু আর তলপেটের পেশীর ‘চোট আঘাতের নো এন্ট্রি’তে ঢুকে পড়ে। একটি স্বাভাবিক বোলিং রূপকথা অকালে ঢলে পড়েছিল অসীম অনন্তের নিশির ডাকে।