মেসি কি তবে ফুরিয়ে গেছেন?

বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ২-০ গোলের হারে আরো একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলো থেকে বিদায় প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের। তাঁদের বিদায়ের দিনে নিষ্প্রভ ছিলেন দলের সেরা তারকা লিওনেল মেসি। বায়ার্ন রক্ষণ দুর্গের সামনে রীতিমতো অসহায় লেগেছে আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকরকে, সতীর্থরাও বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারেননি এই তারকাকে। ফলে প্রশ্ন উঠছে আগামী জুনেই পিএসজির সাথে শেষ হতে যাওয়া চুক্তিটা কি নবায়ন করবেন এই তারকা। 

বায়ার্নের বিপক্ষে ম্যাচে নিস্ফলা পারফরম্যান্সের পর অনেক বিশেষজ্ঞই ভাবছেন রোনালদোর মতো মেসিরও শীর্ষ পর্যায়ে খেলার সময় ফুরিয়ে আসছে। সাবেক ফ্রান্স এবং পিএসজি উইঙ্গার জেরোমে রোথেন বলেন, ‘আমি কাতারে তাঁর খেলা দেখেছি। সে নিজেকে নিয়ে কতটা কাজ করেছে। জাতীয় দলের হয়ে তাঁর পারফরম্যান্স ভালো হলেও সত্যি বলতে ক্লাবে সে যে পরিমাণ অর্থ পায়, সেই পরিমাণ পারফরম্যান্স দিতে পারেনি। পিএসজি তাঁকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততেই দলে টেনেছিল, কিন্তু সে তা জেতাতে ব্যর্থ হয়েছে।’

সত্যি বলতে পিএসজির গোটা সিস্টেমটাই গলদে পরিপূর্ণ আর লিওনেল মেসি সেই সিস্টেমেরই এক অংশ। দলগত খেলায় কখনো একজনের নৈপুণ্যে শিরোপা জেতা যায় না। আপনি হয়তো ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে এক কিংবা দুই ম্যাচে পার পেয়ে যাবেন, কিন্তু গোটা টুর্নামেন্টে সেটা সম্ভব নয়।

১৯৮৬ বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনার পাশে একজন বুরুচাগা ছিলেন, কিন্তু পিএসজির এই দলে মেসির পাশে বুরুচাগা হবেন কে? বিশ্বকাপের পর থেকেই যেন খানিকটা ছন্দহীন এমবাপ্পে। অন্যদিকে ইনজুরির কারণে নেইমার তো পিএসজিতে আসার পর এখনো দুই লেগ খেলতেই পারেননি কখনো।

পিএসজির মালিকপক্ষ টাকা ঢেলেছে দেদারসে, কিন্তু পুরোটাই তাঁরা করেছে অপাত্রে অস্থানে। তাতে না ছিল কোনো চিন্তা বহিঃপ্রকাশ, না ছিল ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। দুই দলের বেঞ্চের শক্তিমত্তার দিকে তাকালেই ব্যবধানটা স্পষ্ট। পিএসজি যেখানে বদলি হিসেবে নামিয়েছে হুয়ান বার্নাট, নর্দি মুকিয়েলে, বিতশিয়াবু, হুগো একিটেকেদের, সেখানে প্রতিপক্ষ বায়ার্নের বেঞ্চে ছিলেন সাদিও মানে, সার্জে গিনাব্রি, লেরয় সানে, জোয়াও ক্যানসেলোরা। শক্তিমত্তার এই পার্থক্য নিয়ে মেসি একা কতটাই বা টানতে পারতেন পিএসজিকে!

২০২১ সালে পিএসজিতে আসার পর মেসি বলেছিলেন, ‘আমি আরো একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা জিততে চায় এবং সেটার জন্য পিএসজির চাইতে ভালো জায়গা হতেই পারে না।’ কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও পিএসজি এখনো শিরোপা জয় তো দূর, ফাইনালেও উঠতে পারেনি। শিরোপা জিততে মরিয়া নাসের আল খেলাইফি তখন টাকার কথা ভাবেননি, মেসিকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন বন্ধু নেইমার এবং এমবাপ্পের সাথে মিলে দুধর্ষ এক জুটি গড়ার। কিন্তু দিনশেষে ফলাফলটা রয়ে গেছে শূন্যতেই। 

তাছাড়া মেসি নিজেও নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি ফরাসি ক্লাবটিতে। প্রথম মৌসুমে তো মানিয়ে নিতে না পেরে মৌসুমের অর্ধেকটা জুড়ে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। এবারের মৌসুমের শুরুটা অবশ্য করেছিলেন দুর্দান্তভাবে, কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে ফিরতেই খানিকটা ছন্দহীন এই তারকা। যেন বিশ্বকাপেই নিজের সেরাটা দিয়ে ফেলেছেন এই তারকা। অনেকে তো তাই এমনটা ভাবছেন, সম্মান বজায় থাকতে মেসির উচিত শীর্ষসারির ফুটবলকে বিদায় জানানো। অন্যথায় আগামী দিনগুলোতে পিএসজির পরিস্থিতি আরো বাজে হবে। 

বড় ম্যাচে মেসি হারিয়ে যান – সমালোচকদের এমন দাবি বহু পুরনো। পিএসজিতে নাম লেখানোর পর থেকেই সেই পুরনো রোগটাই যেন আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপপর্বে টানা গোল পেলেও নকআউট পর্বের ম্যাচে তাঁর বাজে পারফরম্যান্স রীতিমতো ক্ষেপিয়ে দিয়েছে পিএসজির সমর্থকদের। রোথেন নিজেও সমালোচনা করেছেন মেসির।

তিনি বলেন, ‘আপনি বছরে ১৮ গোল কিংবা ১৬ গোল করতে চান ক্লেয়ারমন্ট কিংবা অ্যাঞ্জার্সের বিপক্ষে? কিন্তু যখনই আপনাকে দলের প্রয়োজন, তখনি আপনি হারিয়ে যান।’

বায়ার্নের বিপক্ষে হারের পর একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেছে পিএসজির সাথে চুক্তি নবায়ন করছেন না মেসি। পিএসজি কর্তৃপক্ষও হয়তো আর চাইবে না মেসির উপর বিনিয়োগ করতে। ফলে ঘুরেফিরে সেই পুরনো প্রশ্নটাই জেগে উঠছে, মেসি কি আবারো বার্সায় ফিরবেন? মেসি যদি শীর্ষসারির ফুটবলে আরো কয়েক বছর খেলতে চান, তবে বার্সায় ফেরাটাই হবে তাঁর জন্য সেরা সিদ্ধান্ত। বার্সা কোচ জাভিও জানিয়েছেন মেসির জন্য তাঁর দলের দরজা সবসময়েই খোলা। ‘

তবে অর্থনৈতিক দেনায় জর্জরিত বার্সার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মেসির এত বেতন তাঁরা দিতে পারবে না। সেক্ষেত্রে কাতালান ক্লাব ফিরতে মেসিকে হয়তো তাঁর বেতন কমাতে হবে। মেসি হয়তো পিএসজিতে থাকলে কিংবা মেজর লিগ সকারে গেলে বেশি টাকা পাবেন। কিন্তু  ক্যাম্প ন্যুতে ফেরাটাই হবে তাঁর ব্যক্তিগত এবং ফুটবল ভবিষ্যতের জন্য সেরা সিদ্ধান্ত। 

সবমিলিয়ে তাই সামনের দিনগুলো মেসির জন্য কঠিন হতে যাচ্ছে। জাতীয় দলের হয়ে মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্স জানান দেয় মেসি এখনো ফুরিয়ে যাননি। কিন্তু রোথেনের দাবিও উড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই, অন্তত বায়ার্নের বিপক্ষে ম্যাচের মতো অসহায় মেসিকে আগে কখনো দেখা যায়নি। তিন মাস আগে কাতারের মেসির সাথে এ যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মেসিকে তাই ভাবতে হচ্ছে তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে। পিএসজিতে যোগ দেয়া ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য বাজে এক সিদ্ধান্ত, চুক্তি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে সেটা আরো অবনতির দিকেই যাবে নি:সন্দেহে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link