দিনবদলের স্বপ্নটা কোনোদিন হারিয়ে ফেলতে নেই

কোনো মতে কেটে যাওয়া আর প্রাণভরে বেঁচে নেওয়ার মধ্যে একটা চিকচিকে জলের কণা। তাতে আলো পড়লে ফিরে ফিরে আসে কেবল বিষাদ।আলাদা আলাদা রঙে। মিশে যায় রোজের যাপনে। জীবনগুলোকে ঘোলাটে প্যালেটের মতো লাগে। একদলা মানুষ ট্রেনে চেপে অফিস যায়। হকারি করে কেউ।

আস্তাকুড়ে ভনভনে মাছির ঝাঁক পেরিয়ে যে ছেলে বোতল কুড়োয়, কারও ফেলে দেয়া মেসি জার্সি তার গায়ে; ময়লা। রঙওঠা। সাদা আর নীল আলাদা করা যায় না। যেমন বয়সের দিকে তাকালে আর আলাদা হয় না আমাদের এক একটা দিন, সব মিলেমিশে এক।

ছত্রিশ বছরে সবার অপেক্ষা এমনই, আলাদা আলাদা। টাউনশিপের ওপর বসে দেখা একের পর এক ভেঙে যাওয়া; কেউ বা রিকশা টানতে টানতে জেনেছে কেবল মেসি বলে একটা লোকের গল্প, মাইলখানেক দূরে থাকে হয়ত। বল খেলে। গোল দেয়। টিভির সামনে ভিড় দেখলেই ফ্যাটফ্যাটে চোখ খুঁজেছে ওকে, কই? কে ছেলেটা? ঐ যে, ছোটোখাটো-বল পেলেই কেমন বাঁ পায়ে টেনে টেনে এগোয়… ‘ওকে জিতিয়ে দিও শালিখঠাকুর!’

এইসব বৃত্ত, এসবের বাইরে আটের দশক, হাউ হাউ কেঁদে ফেলা ম্যারাডোনর সামনে ভোকাট্টা হয়ে যাওয়া স্বপ্নের ঘুড়ি, রোমারিও-বেবেতোর সেলিব্রেশনের পাশে আন্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুধু একের পর এক জাল কেঁপে যাওয়া, ডেনিস বার্গক্যাম্পের বি পি এল টিভি থেকে মারিও গোটজের ব্যাটারি রিমোট ছুঁড়ে বালিশে মুখ গোঁজে আড়াই দশক, দুটো প্রজন্মের কৈশোর। স্বাভাবিক হতে হতে আরও একঘেয়ে হয়ে যায় জীবনে, এই সব ব্যথারা। সয়ে যায়।

একদিন আচমকা বৃষ্টি নামে। ভিজতে ইচ্ছে হয় সব্বার। ঝাপসা কাচের ভেতর দেখা যায় ছিপছিপে অবয়ব। মারাদোনার আনিমেটেড চরিত্র নেই, মেসির স্থিতধী উপস্থিতি নেই, বিয়েলসার প্রজ্ঞা নেই, পেকেরম্যানের রোয়াব নেই, শুধু একটা অবয়ব আছে। সে ছায়াকেই জাপটে ধরতে চাইছে মানুষ।

১৮ ডিসেম্বর একটা বুকমার্ক। মেঘ করে আসা আকাশে, যেখান থেকে উপন্যাসের পাতায় বৃষ্টি নেমে আসে। মেঘের পূর্বাভাস কি দেন নি? দিয়েছিলেন। আমরা বুঝিনি, বা বুঝেছিলাম। ডি মারিয়াকে মোক্ষম ম্যাচে আপনি বাঁ দিকে ঠেলে দেবেন।

আপনি ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে মিডফিল্ড প্লে-র অঙ্কটাই ঘেঁটে দেবেন, আপনি মেক্সিকোর বিরুদ্ধে এঞ্জো আর আলভারেজকে নামিয়ে ঝড়ের রাতে টলমলে তরী সামলাতে নিজেই দাঁড় টানবেন। হল্যান্ডের বিরুদ্ধে মলিনাকে বারবার ওভারল্যাপে তুলে মেসিকে নিজের তূণী থেকে একটার পর একটা তির বের করার সুযোগ করে দেবেন। ব্রাজিল-পর্তুগাল-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স হেভিওয়েট নামের ভিড়ে আর্জেন্টিনাকেও ভাসিয়ে রাখবে আপনার শক্ত চোয়াল।

আপনি শিখিয়েছিলেন, বাঁশের কেল্লাও একটা প্রতিরোধ। কেউ পারেনি। কেউ না। স্বয়ং লিওনেল মেসি ও না। আপনি পেরেছিলেন। আপনি শিখিয়েছিলেন শুধু দিনবদলের স্বপ্নটা কোনোদিন হারিয়ে ফেলতে নেই। খেলা ঘুরবে একদিন। শুধু কাউকে একটা রুখে দাঁড়াতে হয়।

সিসিফাসের অনন্ত অভিশাপ যেমন সত্যি, আমাদের ছত্রিশটা বছর যেমন সত্যি, তেমনি হাজার হাজার মিম-ট্রল-সমালোচনার ভেতর থেকে, বুয়েন্স এয়ার্স প্রভিন্সের অলি গলি থেকে আপনার প্রমিথিউস হয়ে বেরিয়ে আসাটাও সত্যি। যে সত্যি আমাদের বলে, দিন আর দিন হয়ে থাকবে না শুধু। স্মৃতি হবে।

তার গায়ে সোনালি ফ্রেম বসবে। মুখে পড়বে আবহমানের আলো। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে দাঁড়ানো মুর্তাদা আমাদি থেকে সুদানের এক পেয়ে নেমিলা, আড়াই দশক জুড়ে গুম মেরে থাকা কয়েক কোটি কৈশোর থেকে মাঝ যৌবনের ক্লান্তি- সব্বাই, সবকিছু, একটা তুলি পাবে। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেলেও যারা যখন ইচ্ছে সেই তুলি দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারবে নিজস্ব ক্যানভাস।

আপনি তখন হাসবেন কেবল। কিংবা জলের বোতল থেকে এক সিপ জল খেয়ে মুখটা দুহাতে ঢেকে ফেলবেন। শান্তভাবে স্মৃতিটুকু ছুঁয়ে থাকবেন। যেভাবে ছুঁয়ে আছেন ঐ সোনালি ট্রফিখানা। পিটার ড্র‍্যুরি বলেছিলেন- ‘Scaloni will be feted…’, এ বিশ্বাস আরও জোরালো করে ফিরিয়ে দিতে পারি আমরা। আপনি থাকবেন। আপনিই থাকবেন। জীবন অনন্তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link