দশ দিগন্ত পার করে

অফ স্ট্যাম্পের ওপর ফুল লেন্থের বল। তিনি আলতো করে মিড অফে পুশ করে  দিলেন। জীবন বাজি রেখে একটা দৌড় দিলেন। উইকেট বাচাতে ডাইভ দিয়ে শুয়ে পড়লেন।

গ্যালারিতে শুরু হয়ে গেলো উল্লাস। মুশফিকুর রহিম এই প্রান্ত থেকে উল্লাস করতে করতে তার দিকে এগিয়ে গেলেন। পিঠে ব্যাট দিয়ে আলতো বাড়ি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু তিনি শুয়েই রইলেন। যেনো ভুলে গেছেন, কী করতে হবে। যেনো, জানেন না যে, কী করতে হবে।

হ্যা, অজানা এক চূড়ায় উঠলেন প্রথমবারের মত লিটন কুমার দাস। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে গেলেন।

কিন্তু সাধারণ এই কথায় ‘প্রথম’ সেঞ্চুরিটার মাহাত্ম কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না।

এটা তো কেবল এক সেঞ্চুরি নয়। যেনো রবার্ট ব্রুসের মত বারবার চেষ্টার এক ফসল। যেনো হার মানতে না চেয়ে লড়ে যাওয়ার এক অসামান্য দৃষ্টান্ত। এই সেঞ্চুরির মাইলফলকে পৌছাতে একবার, দু বার নয়; দশ বার গুনে গুনে ব্যর্থ হতে হয়েছে লিটনকে। তবে এসে ধরা দিয়েছে সেই শত রান।

এই ম্যাচের আগে লিটন ৯টি টেস্ট ফিফটি করেছেন। এর মধ্যে নিশ্চিত দু বার এবং আধা নিশ্চিত চার বার সেঞ্চুরি মিস করেছেন। দু বার ৭০ ও ৭১ রানে আউট হয়েছেন। দু বার ৯৪ ও ৯৫ রানে আউট হয়েছেন। বারবার ওই কাছে যাওয়াটা হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুতেই টেস্টে তিন অংকের দেখা পাচ্ছিলেন না। এর মধ্যে তিনটি ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেয়ে গেছেন। জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেই টেস্ট সেঞ্চুরি অধরাই থেকে গিয়েছিলো।

সেই সেঞ্চুরিটাও এলো কী এক অদ্ভুত সময়ে।

টি-টোয়েন্টির ভয়াবহ বাজে ফর্মের কারণে জীবনটাই তার দুঃসহ হয়ে উঠেছিলো। ব্যক্তিগত ছুটি কাটাতে গিয়েও ট্রল আর ঘৃণার শিকার হয়েছেন। এর নির্বাচকরা নাকি তাকে ‘স্থায়ীভাবে’ টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ দিয়েছেন। সবমিলিয়ে সময়টা একেবারে বিপরীতে ছিলো। কিন্তু লিটনের সময়টা এমন থাকার কথা ছিলো না।

পরিসংখ্যান বলছে, টেস্টে স্বপ্নের মত একটা বছর কাটাচ্ছেন লিটন।

বাকী ফরম্যাটে যেমনই হোক, টেস্টে শুরু থেকেই লিটন দারুন ছন্দে। এই বছরটায় সেই ছন্দ যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। একটা ছোট তথ্য দিয়ে রাখা যাক। এ বছর সারা বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান তিনি।

নির্ধারিত উইকেটরক্ষক হিসেবে চলতি ২০২১ সালে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান রিশাভ পান্টের তিনি। ১১টি ম্যাচ খেলেছেন। তার চেয়ে গুনে গুনে ৫ ম্যাচ ও এক ইনিংস কম খেলা লিটন আছে দুই নম্বরে; কার্যত গতকালই ডিকাভেলাকে টপকে দুই নম্বরে এসেছেন।

দিনশেষে ১০৯ রানে লিটন যখন ব্যাট করছেন, তখনকার হিসেব অনুযায়ী এই বছরে তার মোট রান ৪৮৩। আর এই রানটা করেছেন তিনি ৬০.৩৭ গড়ে। আর এই গড়ের জায়গাটাতে লিটন আছেন বর্ষসেরা অবস্থায়। এ বছর তার চেয়ে বেশি গড়ে কোনো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান রান করতে পারেননি।

তারপরও লিটন ওই টি-টোয়েন্টির কারণে ছিলেন ভয়াবহ চাপে।

সেই চাপটা ব্যাট হাতে মোলায়েম ভঙ্গিতে দূরে সরিয়ে দিলেন। চোখ জুড়ানো ব্যাটিং করলেন। একেবারে লিটনসূলভ সব কাট, কাভার ড্রাইভ আর ফ্লিকে ভরে রইলো দিনটা। তাও আবার কেমন সময়ে?

যখন উইকেটে এলেন, তখন ৫০ রানের কমে ৪ উইকেট হারিয়ে থরথর করে কাঁপছে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। সেই সময়টায় মুশফিককে নিয়ে এক মহাকাব্যিক জুটি করলেন। দলকে টেনে তুলে নিলেন চালকের আসনে।

হ্যা, ইনিংসে দু বার জীবন পেয়েছেন; একবার মিড উইকেটে, একবার স্লিপে ক্যাচ পড়েছে। এটা লিটনের জন্য নেতিবাচক খবর হলে আবার আরেকটা লড়াই আছে তার। প্রায় সারাটা ইনিংস ব্যাট করেছেন ব্যাথা সহ্য করে। ইনিংসের মাঝপথে প্রথম পিঠের মাংসপেশীতে টান লাগে। সেটা নিয়ে দাতে দাত চেপে লড়েছেন। এরপর সেঞ্চুরির আগে আগে হাতের পেশীতে ব্যাথা পেয়েছেন। কিন্তু থেমে যাননি।

থেমে না গিয়ে লিটনের এই লড়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটা বিজ্ঞাপন হয়ে রইবে। ফলাফল বা শেষ অর্জন যাই হোক, অন্তত লিটনরা বলতে পারবেন, আমরা লড়েছিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link