ব্যাটটা দুহাতে নিয়ে মাথাটা একটু নিচে করে বাইশ গজের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। চোখগুলো মাটির দিকে থাকে তবে সেটা ভয়ে নয় বরং একটা নম্রতার প্রকাশ পায়। ব্যাট হাতে লিটনের বাইশ গজে নামাটা এখন বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের এক উপলক্ষ্য। লিটন তাঁর নম্রতা দিয়েই মাত করে রেখেছেন একটা গোটা ক্রিকেট রাজ্য।
একেবারেই কম কথা বলা নম্র, ভদ্র এক ক্রিকেটার। সংবাদ সম্মেলনে এসেও দুই-এক কথায় উত্তরটা দিয়ে ফেলতে চান। একটু নিজের মধ্যে থাকতেই যেন পছন্দ করেন। বাইশ গজে ব্যাট হাতে নামলেও লিটনের এই স্বভাবটা বোঝা যায়। লিটনের ব্যাট এখন অনেক কথা বললেও প্রতিটা ইনিংসই যেন একটা শীতল বাতাসের মত শরীরটা ঠান্ডা করে দিয়ে যায়।
অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা না যখন অধিকাংশ মানুষ তাঁর উপর আর ভরসার হাতটা রাখছেনা। দর্শকদের নানা সমালোচনা তো আছেই এছাড়া ক্রিকেট বোর্ড থেকেও তাঁকে নিয়ে কত আলোচনা। যেন লিটন শুধুই এক আক্ষেপের নাম হয়ে থাকবেন।
সত্যি বলতে এই গতবছরও লিটন দাস এই সময়টা পার করেছেন। যখন তাঁর পাশে দাড়ানোর মত একটা মানুষ ছিল না। বিসিবির বড় বড় কর্তারা মিডিয়ার সামনে এসে লিটনের সমালোচনা করেছেন। এমনকি লিটনকে আর পরিকল্পনায় না রাখার কথাও শোনা গিয়েছে। আর সেই লিটনই এখন বাংলাদেশকে নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে বাধ্য করেছে।
যেই দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলেন সেই দেশের মানুষই সমানে গালাগালি করে যাচ্ছে। নিজের ক্রিকেট বোর্ড জনসম্মুখে তাঁকে শেষ ঘোষণা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজারটা ট্রল দেখতে হচ্ছে। সেই সময় রান পাচ্ছিলেন না বলে তাঁর স্কোরের উপর অনলাইন দোকান গুলো ছাড় দিচ্ছে। আরো কত কী!
ক্রিকেট মাঠের বাইরের এই লড়াইটাও লিটনকে লড়তে হয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর বলা হয়েছিল রঙিন পোশাকের ক্রিকেটের পরিকল্পনাতেই লিটনকে রাখা হবেনা। লিটন সেই পরিকল্পনার দুয়ার ভেঙেছেন বিপিএলে পারফর্ম করে। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশ তাঁকে নিয়েই পরিকল্পনা সাজাতে বাধ্য হয়েছে।
টেস্ট ক্রিকেটে অনেকদিন ধরেই নিয়মিত রান করছিলেন। ছয়-সাতে নেমে ছোট ছোট কিছু ইনিংস খেলে যাচ্ছিলেন। তবে সেখান থেকে ইনিংসগুলোকে খুব বড় করতে পারছিলেন না। সেখান থেকে লিটন এখন নিয়মিত বড় ইনিংস খেলছেন। গত ছয় মাসে টেস্ট ক্রিকেটে তিনটা সেঞ্চুরি করেছেন, চারটা হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। মিরপুরে ১৪১ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেছেন।
ওয়ানডে ফরম্যাটেও শেষ পাঁচ ইনিংসে তিনটা হাফ সেঞ্চুরি, যার একটা আবার সেঞ্চুরি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ১৩৬ রানের বিশাল ইনিংস। দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে তামিমকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন। ম্যাচের শুরুতেই দলকে এগিয়ে দিয়েছেন।
গতবছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর টি-টোয়েন্টি দলে তাঁর ফেরাটা কঠিন ছিল। তবে বিপিএলে যে ঝড় উঠিয়েছিলেন এরপর তাঁকে দূরে রাখা যায়নি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে টি-টোয়েন্টি ম্যাচও খেললেন। প্রথম ম্যাচেই ৪৪ বলে ৬০ রানের ইনিংস। দেখিয়ে দিলেন ফিরে আসার গল্পগুলো কীভাবে লিখতে হয়।
টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই তিনি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। এই সবকিছুই তিনি অর্জন করেছেন গত ছয় মাসে। কারণ এর আগে লিটন একটা কঠিন সময় পার করে এসেছেন। সবাই ভেবেছিল লিটন শেষ, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছেন। তবে লিটন জানতেন তিনি ফিনিক্স পাখি।