লিভিং টু দ্য ফুলেস্ট

তবে এত কিছু ভাবলে তো তিনি গোছানোই হতেন। জীবনটা তিনি নিজের মতো করেই চালিয়েছেন। বিনোদন যেমন দিয়েছেন, তেমনি নিয়েছেনও। উপভোগ করেছেন ক্রিকেট ও জীবন। তাঁর ক্যারিয়ার হয়তো অপূর্ণতার গল্প, তবে তাঁর জীবন নয়। স্রেফ ৪৬ বছরের জীবন, তবু অপূর্ণ নয়। উপভোগের কমতি তো রাখেননি!

অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের বয়স তখন ২০ বছর। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে গ্লস্টারশায়ারের হয়ে গ্ল্যামরগনের বিপক্ষে খেললেন ২০৬ বলে ২৫৪ রানের অপরাজিত ইনিংস। কোন পরিস্থিতিতে? দল ৭৯ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর। ১৬টি ছক্কা মেরেছিলেন সেদিন, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড ছিল সেটি তখন। সেটি ১৯৯৫ সালের কথা।

২০০৪ সালের আরেক ইনিংসের গল্প বলি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের তখনও কেবল শুরুর সময়। মিডলসেক্সের বিপক্ষে কেন্টের রান যখন ১৪৩, সাইমন্ডস আউট হলেন ১১২ রান করে। ৩৪ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন সেদিন। ২০১৩ সালে ক্রিস গেইল ৩০ বলে সেঞ্চুরি করার আগ পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল সাইমন্ডসেরই।

এই দুটি ইনিংসের কথা বললাম তিনি কী ‘জিনিস’ ছিলেন, এটা সামান্য বোঝাতে। এমনিতে রেকর্ড-পরিসংখ্যা-সংখ্যা, এসব তাকে বোঝাতে পারে সামান্যই। তাকে যারা দেখেননি, তারা কখনোই বুঝবেন না, কখনোই না, সাইমন্ডস ‘কী’ ছিলেন।

আগ্রাসী ও বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান, ভয়ডরহীন মানসিকতা, পেশিশক্তি ও শরীরী ভাষায় গুঁড়িয়ে দিতেন প্রতিপক্ষকে। উইকেটে তার উপস্থিতি, তার পদচারণাই ছিল প্রতিপক্ষের জন্য ভীতি জাগানিয়া। বোলিংয়ে মিডিয়াম পেস আর অফ স্পিন, দুটিতেই বুদ্ধিদীপ্ত ও ব্যাটসম্যান বুঝে বল করায় দারুণ কার্যকর।

আর ফিল্ডিং? স্রেফ তাঁর ফিল্ডিং নিয়েই মহাকাব্য লেখা যায়। অসাধারণ অ্যাথলেট ছিলেন। তার রিফ্লেক্স ও অ্যান্টিসিপেশন, রানিং, ক্যাচিং, ডাইভিং সবই ছিল অবিশ্বাস্য। বিশাল এই শরীর নিয়ে চোখের পলকে ডাইভ দিতেন, রিকভারি ছিল আরও দ্রুত।

তার ফিল্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় দিক, মাঠের সব জায়গায় ছিলেন সমান দক্ষ। জন্টি রোডসকে সর্বকালের সেরা ফিল্ডার মানেন অনেকে। ‘অলরাউন্ড’ ফিল্ডার হিসেবে যদিও আমি একটু এগিয়ে রাখি রিকি পন্টিংকে। তবে ‘অলরাউন্ড’ ফিল্ডার হিসেবে আরও এগিয়ে ছিলেন হয়তো সাইমন্ডস। বিশেষ করে তার থ্রোয়িং, আহ, অবিশ্বাস্য নিখুঁত নিশানা ছিল তার। তিনি বল ছোঁড়া মানে স্টাম্পে হিট করবেই।

আমরা অলরাউন্ডারদের কথা বলি। সাইমন্ডস ছিলেন আল্টিমেট অলরাউন্ডার। আমরা অলরাউন্ড প্যাকেজের কথা বলি। সাইমন্ডস ছিলেন আকর্ষণীয় এক প্যাকেজ। টি-টোয়েন্টির জমানায় এখন ‘ইম্প্যাক্ট’ ক্রিকেটারদের সময়। ইম্প্যাক্টের দিক থেকে সাইমন্ডস ছিলেন ‘ড্রিম’ ক্রিকেটার।

২০০৩ বিশ্বকাপে তার ইনিংসটি তো বহুল আলোচিত। তখনও পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া দলে জায়গা পাকা করতে লড়ছিলেন তিনি। ওই ম্যাচের আগে অস্ট্রেলিয়ার জন্য ধাক্কা হয়ে আসে ড্রাগ নিয়ে শেন ওয়ার্নকে দেশে ফেরত পাঠানো। ওই ইনিংসের আগে ৫ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে আসা-যাওয়ার পালায় তার গড় স্রেফ ২৩। এরপর?

৮৬ রানে ৪ উইকেট পড়ার পর নেমে ১২৫ বলে অপরাজিত ১৪৩। প্রতিপক্ষের বোলিং আক্রমণে ছিলেন ওয়াসিম-ওয়াকার-শোয়েব-রাজ্জাক-আফ্রিদি! বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ইনিংসগুলোর একটি।

তার আরেকটি ইনিংস নিয়ে আলোচনা কমই হয়। সেটি ২০০৬ সালের ভিবি সিরিজের। দুই ওভারের মধ্যে তিন উইকেট নেন চামিন্দা ভাস। ৩ উইকেটে ১০, এই অবস্থায় উইকেটে গিয়ে সাইমন্ডস করেন ১২৭ বলে ১৫১। বোলি আক্রমণে ছিল ভাস, কুলাসেকারা, মুরালিধরন, জয়াসুরিয়া। রিকি পন্টিংও সেঞ্চুরি করেছিলেন সেদিন। শুরুর বিপর্যয়ের পরও অস্ট্রেলিয়া ৫০ ওভারে তোলে ৩৬৮ রান।

ওই অস্ট্রেলিয়া দলটাই ছিল অমনই অসাধারণ। তাতে বড় ভুমিকা ছিল সাইমন্ডসের। তাঁর জন্ম বার্মিংহামে। জন্মের পরপরই তাকে দত্তক নেয় এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি। নতুন পরিবারের সঙ্গে মাত্র তিন মাস বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসেন তিনি। এটাই হয়ে ওঠে তার দেশ।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সিস্টেমেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। তবে জন্মভূমি ইংল্যান্ডেও খেলতেন নিয়মিত। ২০ বছর বয়স থেকে খেলতেন কাউন্টি ক্রিকেট। দারুণ পারফরম্যান্সে ইংল্যান্ড ‘এ’ দলে ডাক পেয়ে যান। কিন্তু সেই ডাক তিনি উপেক্ষা করেন। স্বপ্ন ছিল তার অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা।

১৯৯৮ সালে স্বপ্ন পূরণ হয়। ওয়ানডে দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে করেন ৬৮ বলে ৬৮। তার পরও জায়গা থিতু করতে পারেননি। দলে আসা-যাওয়া চালতে থাকে প্রায় ৫ বছর ধরে।

রিকি পন্টিং তাঁকে দারুণ পছন্দ করতেন। লম্বা সময় প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলেও পন্টিং তার ওপর আস্থা রেখে যান। সেটির প্রতিদান মেলে ২০০৩ বিশ্বকাপ থেকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই ইনিংসের পর সেমি-ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আবার বিপর্যয়ের মধ্যে ভীষণ দুরূহ উইকেটে ৯১ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা হন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।

তার আশৈশব স্বপ্ন ছিল অবশ্য ব্যাগি গ্রিন মাথায় তোলা। সেই স্বপ্ন পূরণ হয় ২০০৪ সালে। তবে সাদা পোশাকেও জায়গা পাকা করতে সময় লাগে বেশ। অবশেষে ২০০৬-০৭ অ্যাশেজের বক্সিং ডে টেস্টে ১৫৬ রানের ইনিংস খেলে এই সংস্করণে । ২০০৮ সালে সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে ১৬২ রানের অসাধারণ ইনিংস, ১৩৪ রানে ৬ উইকেট হারানো দলকে ৪৬৩ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার ৪০ সেঞ্চুরি, সাড়ে ১৫ হাজার রান ও ২৭২ উইকেট জানান দিচ্ছে, ওই সময় অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দল এতটা শক্তিশালী না হলে ও কিছু বেশি সুযোগ পেলে, টেস্টেও হয়তো তিনি সফল হতেন আরও।

ক্যারিয়ারে যেটুকু করেছেন তিনি, সীমিত ওভারের ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা তার থাকবে। তবে যদি আরেকটু শৃঙ্খলা মেনে চলতেন, যদি বিতর্কে আরেকটু কম জড়াতে, নিশ্চিতভাবেই ক্যারিয়ার আরও লম্বা হতো, অর্জনে আরও সমৃদ্ধ হতেন তিনি।

তাঁর ক্যারিয়ারের দুটি বিতর্কিত অধ্যায় বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের আগে। ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে ম্যাচের সকালে তিনি হাজির হন মাতাল হয়ে টলমল পায়ে। তাকে প্রত্যাহার করা হলো। কার্ডিফে সেদিন বাংলাদেশের কাছে হেরে গেল অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের বিপক্ষে পরের ম্যাচেই ফিরে তিনি ৫ উইকেট নেন ১৮ রানে, ক্যারিয়ার সেরা বোলিং।

২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের আগে ডারউইনে টিম মিটিং বাদ দিয়ে তিনি চলে যান মাছ ধরতে। এবার বের করে দেওয়া হয় দল থেকে। কদিন পর ভারত সফরে দলেও বিবেচনা করা হয়নি শাস্তি হিসেবে। সিডনির সেই কুখ্যাত ‘মাঙ্কিগেট’ তো আছেই। সেখানে অবশ্য তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্রদের একজন হলেও দায় খুব একটা ছিল না তাঁর।

এছাড়াও আরও অনেক বিতর্কে তিনি জড়ান। প্রতিবারই কিছু সময় পর তাকে রেহাই দেওয়ায় হয় তিনি ম্যাচ উইনার বলেই। অস্ট্রেলিয়া দলের অনেকে তাকে দারুণ পছন্দও করতেন। সতীর্থ ছাপিয়ে অনেকেরই তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পন্টিং-গিলক্রিস্টরা বলতেন, বন্ধু ও মানুষ হিসেবে সাইমন্ডস অসাধারণ। এই ক্রিকেটাররা সবসময় পাশে থেকে গেছেন তাঁর।

তবে ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে আবার মাতলামির ঘটনায় তাকে ফেরত পাঠানো হয় দেশে। এবার ধৈর্য হারায় বোর্ড। বাদ দেওয়া হয় চুক্তি থেকে। আর ফেরা হয়নি। বিতর্কে না জড়ালে আরও কয়েক বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রাঙাতে পারতেন নিশ্চিতভাবেই।

প্রথম আইপিএলের নিলামে সাড়ে ১৩ লাখ ডলার পেয়েছিলেন তিনি। আইপিএলে তৃতীয় ম্যাচেই করেছিলেন বিধ্বংসী সেঞ্চুরি। তবে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টায় আইপিএল বা আরও বেশি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি পেলে তার কাছ থেকে আরও কিছু বিনোদন পাওয়া যেত। স্রেফ ১৪টি টি-টোয়েন্টি খেলতে পেরেছেন তিনি, গড় ৪৮, স্ট্রাইক রেট ১৬৯। আরও খেলতে পারলে আরও কত কিছু দেখা যেত!

তবে এত কিছু ভাবলে তো তিনি গোছানোই হতেন। জীবনটা তিনি নিজের মতো করেই চালিয়েছেন। বিনোদন যেমন দিয়েছেন, তেমনি নিয়েছেনও। উপভোগ করেছেন ক্রিকেট ও জীবন। তাঁর ক্যারিয়ার হয়তো অপূর্ণতার গল্প, তবে তাঁর জীবন নয়। স্রেফ ৪৬ বছরের জীবন, তবু অপূর্ণ নয়। উপভোগের কমতি তো রাখেননি!

এই যে শেন ওয়ার্ন চলে গেলেন, এখন সাইমন্ডস, জীবন তাদের খুব বড় না হলেও উপভোগ করেছেন পুরোপুরি। টু দ্য ফুলেস্ট। তাদের জীবন ও মৃত্যু আপনাকে এই বার্তা দেবে, একদিন তো চলে যেতেই হবে। ততদিন ছাপ রেখে যাও আর উপভোগ করে নাও।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...