সম্রাট নেই, সাম্রাজ্য আছে

আমরা এখনও অতটা বুড়ো হইনি যে পেলেকে খেলতে দেখেছি। কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় লালকমল-নীলকমল, গ্রিমস ভাইরা, কথামৃত, পুরাণ, গাভাসকার, বিষেন বেদি, জন ম্যাকেনরো, প্রকাশ পাড়ুকোনের সঙ্গেই চলে এসেছিলেন পেলে। ছেলেবেলা থেকেই পুরো নাম জানতাম। জানতাম, ওই কালো রঙের সুঠাম চেহারার মাঝারি উচ্চতার লোকটি আমার বাবার যৌবনে বিশ্ব মাতিয়েছেন।

আর আমাদের ছেলেবেলায় এক আশ্চর্য সম্রাট হয়ে বসে ছিলেন। পেলে, মহম্মদ আলি। এঁরা সাদাকালো খেলার পৃথিবীকে ইস্টম্যানকালার করে তুলেছিলেন। ব্রাজিলকে ভালো লাগা বলি বটে ‘৮২ দেখে। কিন্তু আদতে তো পেলের নাম শুনে।

পেলে এসেছেন খেলতে ইডেন উদ্যানে। ভারতীয় ফুটবলের ১৯১১, ১৯৫১, ১৯৬২, ইস্ট বেঙ্গলের পাঁচ গোলের মতোই সেটা যুগান্তকারী ঘটনা হয়ে রয়ে গিয়েছে। সেই বড়ে মিয়াঁর ‘ইউ পেলে, আই মহম্মদ হাবিব’, সেই গৌতম সরকারের জীবন বাজি রাখা ট্যাকল আর শেষমেশ শিবাজী ব্যানার্জি। পেলের পেনাল্টি (আদতে ফ্রিকিক) বাঁচিয়েই তো শিবাজী আমার হিরো হয়ে গেলেন।

সেই পেলের দেশের খেলা যখন দেখলাম ’৮২-তে তখন থেকেই পেলে আছেন। মাঠে জিকো দুজনকে ড্রিবল করে এডারকে বল দিলেন, যেন পেলে দিলেন। দূর পাল্লার শটে সক্রেটিসের গোল, যেন পেলের গোল। ফালকাও, জুনিয়র, সেরেজোরা এক একজন পেলে। পেলের দল ইতালির কাছে হেরেছিল ৩-২।

পেলের দলের সামনে ভাকরা নাঙ্গাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জোয়েল বাতস, পেলের দলের শটগুলো বারে আর পোস্টে লেগে ফিরে এলে মারাদোনা হৃদয় ভেঙে দিয়েছিলেন। শেষে দুঙ্গা নয়, পেলের হাতেই উঠেছিল রোজ বোলে। রোমারিও, বেবেতো, জিকো, কারেকা, আর তারপর এক ঝাঁক রোনালদো। বছর বছর পেলেই ফিরে এসেছেন এঁদের পা ঘুরে।

বাঙালি পেলেকে যৌবনে খেলতে দেখেনি। ১৯৭৭-এর এক বিকেলে তার খেলা দেখেই বাঙালির রঙ হলুদ সবুজ হয়ে গিয়েছিল, যাকে নীলনদের মতো দুফাঁক করতে আরেক ক্ষণজন্মার মোজেসের লাঠির মতো বাঁপা চালাতে হয়েছিল ৯ বছর পরে।

তবু আমরা পেলেকে দেখিনি, তবু আমরা পেলেকে দেখেছি। দেখেছি মুকুট পরা স্যুটেড বুটেড একটা লোককে, দেখেছি শ্বেতকায় ববি মুরের সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে আছেন কালো পেলে, দেখেছি গর্ডন ব্যাঙ্কসকে পেলেরই হেড বাঁচাতে হয়ে উঠতে হয়েছে অতিমানব, দেখেছি সুইডেনের বিরুদ্ধে জিঙ্গা খেলতে খেলতে একটা ১৭ বছরের বাচ্চা দু’ দুটো গোল করে দিল, দেখেছি হাঙ্গারির কাছে হারার পর পর্তুগাল ম্যাচে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠের বাইরে যেতে, দেখেছি উরুগুয়ের সঙ্গে বিশ্বের সেরা ডামি দিতে, দেখেছি এক ঝলক দেখে কার্লোস আলবার্তোর জাল ছিঁড়ে দেবার বল সাজিয়ে দিতে।

শ্যাম থাপা যখন ব্যাকভলি মারেন তখন তিনি পেলে হয়ে যান। রোনালদো নাজারিও যখন ববি রবসনের মাথার চুল ছেঁড়ানো দৌড় মারেন তখন তিনি পেলে হয়ে যান, রবিনহো যখন বল মাঝখানে রেখে শরীরে এক বাঁকে ডিফেন্ডারকে জমি ধরান তখন তিনি পেলে হয়ে যান, দুপায়ে গোলার মতো শট নিয়ে ওয়েন রুনি পেলে হয়ে যান, আকাশে ভাসতে ভাসতে হেড দিতে গিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো পেলে হয়ে যান।

সাদা পেলে, কালো পেলে, বাদামি পেলে, আল্পসের পেলে, বলকানের পেলে, আন্দিজের পেলে, ভারতের পেলে, পূর্বের পেলে, পশ্চিম এশিয়ার পেলে। পেলে সর্বত্র আমাদের চোখের সামনেই ঘুরে বেড়ান। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেলে হয়ে ফুটবল বদলে বদলে যায়, পেলের ছবি বদলায় না।

জেয়ারজিনহোর পিঠে উঠে শূন্যে ডানহাত মুঠো করে রাখা পেলের ছবিটা ক্যানারি হলুদের মতোই থেকে যায় আমাদের মনে। ব্রাজিলের ব্যর্থতা, ব্রাজিলের সাফল্য, ব্রাজিলের ফুটবল, ব্রাজিলের ড্রিবল, ব্রাজিলের ছবির মতো তরঙ্গায়িত খেলা, ব্রাজিলের সংস্কৃতি আমাদের কাছে উঠে আসে পেলে হয়ে।

পেলেকে আমি খেলতে দেখিনি কখনও, তবু ওই চামড়ার গোল বলটা যখন সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে ছুটে চলে, তখন মাঠের প্রত্যেকটা ছুটন্ত মানুষ পেলে হয়ে যায়। অচিন গাঁয়ের এবড়োখেবড়ো মাঠই হোক বা মারাকানার প্রান্তর। প্রতিটি ফুটবলপ্রেমী কখনও না কখনও পেলে হয়ে গিয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে রক্তের কণায় কণায়। পেলের মৃত্যু হয় না। পেলে তাই চলে গেলেও আরও বেশি করে থেকে যান ফুটবলের আত্মা হয়ে।

দ্য এম্পেরর ইস ডেড, লং লিভ দ্য এম্পেরর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link